মঙ্গলবার (১৬ অক্টোবর) ঘোষিত ফলাফলে ২৬ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাসের হারে এটা রেকর্ড।
মেধাতালিকায় থাকা কিছু শিক্ষার্থীর দুই ইউনিটের ফলাফলের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে। ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এদিকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি প্রক্রিয়া বাতিলসহ চারটি দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আখতার হোসেন গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আমরণ অনশন শুরু করেছেন।
তার এই অনশনের সমর্থনে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আজ তার পাশে বসে থাকতে দেখা গেছে। বুধবার (১৭ অক্টোবর) বিকেল ৫টায় আন্দোলনে সমর্থন জানায় কোটা সংষ্কার আন্দোলনের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। প্রশ্ন ফাঁসের বিচারে সরব বাম ছাত্র সংগঠনগুলোও। ঢাবি ‘ঘ’ ইউনিটে রেজাল্ট নিয়ে সমালোচনা তাই তুঙ্গে।
এদিকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬-২০১৭ সেশনে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে তা হয় ১৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর এবছর ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২৬ দশমিক ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
রেজাল্টের অস্বাভাবিকতা বিষয়ে উপাচার্য ভর্তির ফল প্রকাশের দিন সাংবাদিকদের বলেন, এটা একেবারেই সত্য আমাদের অন্য যে ইউনিটগুলো, সেই ইউনিটের দ্বিগুণ। কিন্তু এটা দেখার পরে, জানার পরে আমাদের প্রশ্ন ছিল, এটা ডিন ম্যাডাম ভালো বলতে পারবেন।
‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষার ফলাফল যাচাই করে দেখা গেছে এই ইউনিটে সর্বোচ্চ মেধাতালিকায় থাকা একাধিক ভর্তিচ্ছু তাদের নিজের ইউনিটের পরীক্ষায় পাসই করতে পারেননি। অথচ কয়েক দিনের ব্যবধানে আরেক ইউনিটের পরীক্ষায় রীতিমতো ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছেন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ‘ঘ’ ইউনিটে মেধাতালিয়ায় ১০০ ক্রমের মধ্যে থাকা ৭০ জনের বেশি শিক্ষার্থী তাদের নিজ নিজ অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি।
জাহিদ হাসান আকাশ ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। গত ১২ অক্টোবর তিনি ঢাবির সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তির জন্য ‘ঘ’ ইউনিটে পরীক্ষা দেন। সেখানে ব্যবসায় শাখা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। অথচ ব্যবসায় শিক্ষা শাখার এই শিক্ষার্থী বাণিজ্য অনুষদে ভর্তির জন্য দেওয়া ‘গ’ ইউনিটের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাবির ‘গ’ ইউনিটের পরীক্ষায় তিনি বাংলায় পেয়েছিলেন ১০.৮ ইংরেজিতে পেয়েছিলেন ২.৪০। অথচ এই শিক্ষার্থী ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় বাংলায় ৩০ এর মধ্যে ৩০, ইংরেজিতে ৩০ এর মধ্যে ২৭.৩০ পেয়েছেন।
অথচ মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় মোট ১২০ নম্বরের মধ্যে তিনি ১১৪.৩০ পেয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০ বছরে ১২০ এর মধ্যে ১১৪.৩০ কেউ পায়নি। এছাড়া ‘ঘ’ ইউনিটে বাণিজ্য শাখায় যিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন ১২০ এর মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৯৮.৪০। মেধাক্রম প্রথম থেকে দ্বিতীয়ের ব্যবধান নজিরবিহীন।
আরেক শিক্ষার্থী তাসনিম বিন আলম ঢাবি ‘ঘ’ ইউনিটে (বিজ্ঞান শাখায়) প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। অথচ বিজ্ঞান শাখার এই শিক্ষার্থী তার নিজের অনুষদ ‘ক’ ইউনিটের পরীক্ষায় ১২০ নম্বরের মধ্যে ৪৩.৭৫ পেয়ে ফেল করেছিলেন। সেই তিনিই ঢাবি ‘ঘ’ ইউনিটে ১২০ নম্বরের মধ্যে ১০৯.৫০ পেয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকার বিজ্ঞান শাখায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।
রেজাল্ট বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মশিউর রহমান নামে একজন শিক্ষার্থী লেখেন ‘চিত্র নায়িকা বুবলির ভাই ঢাবির 'ঘ' ইউনিটে বাংলায় ৩০/৩০ সহ ১২০/১১৪ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। আসুন আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই।
বি.দ্র. ছেলেটি ‘গ’ ইউনিটের পরীক্ষায় ইংরেজিতে ২.৪ পেয়ে ফেল করেছিল!
নিগার সুলতানা সুপ্তি নামে একজন শিক্ষার্থী তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন, মাত্র ২০ দিনে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয় তা শিখিয়ে দিয়েছেন এই ভাইটি। ‘গ’ ইউনিটে ইংরেজিতে ২.৪ পেয়ে ফেল করেছে আর ‘ঘ’ ইউনিটে ২৭.৫ পেয়ে ১ম হয়েছে।
‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত শনিবার এক ভর্তি পরীক্ষার্থী ও তার বাবাসহ মোট ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়। রোববার তাদের প্রত্যেককে দু’দিন করে রিমান্ডে পাঠানো হয়।
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা এসএম কামরুল আহসান ছয় জনের নাম উল্লেখসহ আরও বেশ কয়েকজনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২২ ও ২৩ নম্বর ধারা ও পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে এই মামলা দায়ের করা হয়। এতে বলা হয়, পরীক্ষা শুরুর আগে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে।
এদিকে অনশনকারী আখতার বলেন, ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। আমি প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা চাই।
এই প্রতিবাদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবগত কিনা, এ বিষয়ে আখতার বলেন, গত রাতে প্রক্টরিয়াল বডির মোবাইল টিমের দু’জন আমার সঙ্গে কথা বলে গেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবাদ লিপি জমা দেওয়ার চিন্তা করছেন বলেও জানান তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর উপাচার্য জানান, তারা ডিজিটাল জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছেন। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে কাজ করবেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তদন্ত কমিটির এমন প্রতিবেদন সত্ত্বেও কেন ফল ঘোষণা করা হলো? এমন প্রশ্নে উপ-উপাচার্য বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে উপাচার্য মনে করেছেন যে ফল প্রকাশ করতে কোনো সমস্যা নেই, তাই তিনি ফল ঘোষণা করেছেন। আসলে একজন প্রশ্ন ফাঁসকারীর তথ্য পাওয়া গেছে এবং তা দিয়েছেন সাংবাদিকরা। এর পরেই আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। প্রশ্ন ফাঁস আর ডিজিটাল জালিয়াতি যাই বলি না কেন, পরীক্ষা শুরুর আগেই আমাদের হাতে উত্তরপত্র চলে এসেছে। সত্য প্রকাশ হবেই। ধামাচাপা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমি চাই পুরো ব্যাপারটিই প্রকাশিত হোক। ’
অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে ৮১টি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছিলেন। পরে কোনো একটি কেন্দ্র থেকে হয়তো কেউ ছবি তুলে তা অন্যের কাছে পাঠিয়ে দেয়। সে কাজটি আমি, আপনি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে কারো দ্বারাই হতে পারে। ফলে ওই ৮১টি কেন্দ্রের কোনটি থেকে প্রশ্ন ফাঁস হলো তা বের করা কঠিন।
জানতে চাইলে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বাংলানিউজকে বলেন, পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা কাউকে ভর্তি করাইনি। অস্বাভাবিক রেজাল্টের বিষয়টি জেনেছি। আমরা যাছাই-বাছাই করে ভর্তি করাবো। জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাঁস করা প্রশ্নে কেউ ভর্তি হতে পারবে না। আমাদের দাবি পরীক্ষা আবার নিতে হবে। তা না হলে আমরা কর্মসূচি দেবো।
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৮
এসকেবি/এএ