হল প্রশাসনের সিট বণ্টনের কথা থাকলেও সেখানে রয়েছে ছাত্রলীগের কঠোর নিয়ন্ত্রণ। অবস্থা এমন যে, হলে সিট পাওয়ার একমাত্র উপায় সংশ্লিষ্ট হল ছাত্রলীগের ‘অমুক’ ভাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি হলের মধ্যে ছয়টি ছাত্রী হলে ৩ হাজার ৩১৯ জনের এবং ১১টি ছাত্র হলে ৫ হাজার ৩৫ জনের আবাসিক সুবিধা রয়েছে। কিন্তু ধারণক্ষমতার চেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিনগুণ বেশি হলগুলোতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ও গ্রুপে বাগিয়ে নেওয়ার শর্তে দলীয় কর্মী কিংবা পছন্দের কোনো ছোট ভাইকে হলে সিটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আর যাদের সিট দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকের সংশ্লিষ্ট হলে (বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে) সংযুক্তিও থাকে না। শুধু তাই নয়, অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের কাছে সিট বিক্রি করার অভিযোগও রয়েছে। ছাত্রদের হলগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবৈধভাবে অসংখ্য সিট দখলে রেখেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হলগুলো ঘুরে জানা যায়, বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা রুমে রুমে গিয়ে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের লিস্ট করেন। তাদের পরীক্ষা কবে শেষ এবং কবে তারা হল ছাড়বেন এ সময় লিখে নেন তারা। এসব শিক্ষার্থী চলে গেলে ওই সিটগুলো দখলে নেয় ছাত্রলীগ। হল প্রশাসনের বিরুদ্ধেও সিট খালি হলে ছাত্রলীগকে তালিকা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর সাকিব আল হাসান নামে এক শিক্ষার্থী হবিবুর রহমান হলে উঠতে গেলে হল ছাত্রলীগের নেতা মিনহাজুল ইসলাম বাধা দেন। জোরপূর্বক সিট থেকে তার জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে সিটটি দখলে নেন মিনহাজ। যদিও পরে বিষয়টির মীমাংসা হয়। আগের দিনও একই ধরনের ঘটনা ঘটে সোহরাওয়ার্দী হলে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে হলের ৩৪৭ নম্বর কক্ষে তুলে দেন হল প্রাধ্যক্ষ। পরে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মাহমুদুল হাসান শাকিল তাকে সিট থেকে নামিয়ে দেন। প্রাধ্যক্ষ শাকিলের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি বিষয়টি সমাধান করে।
তারও আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি মতিহার হল থেকে অবৈধ এক শিক্ষার্থীকে বের করে দেন প্রাধ্যক্ষ আলী আসগর। পরে আবার ওই শিক্ষার্থীকে হলে তুলে দেয় ছাত্রলীগ। এ ঘটনার জেরে প্রাধ্যক্ষ আলী আসগর পদত্যাগ করেন।
হলে হলে ‘পলিটিক্যাল ব্লক’
প্রতিটি হলেই ‘পলিটিক্যাল ব্লক’র নামে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী নিজেদের দখলে রাখছে অসংখ্য সিট। এজন্য বৈধ আবাসিক শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর সেসব সিটে যাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তারা সিটে উঠতে না পেরেও মাসে মাসে হলের ভাড়া দিচ্ছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের তৃতীয় ব্লকের দ্বিতীয় তলা, হবিবুর রহমান হলের প্রথম ব্লকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা, শহীদ শামসুজ্জোহা হলের প্রথম ব্লকের দ্বিতীয় তলা ও তৃতীয় ব্লকের দ্বিতীয় তলা, জিয়াউর রহমান হলের প্রথম ব্লকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা এবং দ্বিতীয় ব্লকের তৃতীয় তলা, আমীর আলী হলের ২৪১-২৫৮ নম্বর কক্ষ, শের-ই-বাংলা হলের ২১২-২১৯ কক্ষসহ প্রতিটি হলেই ‘পলিটিক্যাল ব্লক’ রয়েছে।
হলে থাকছে বহিরাগতরা
সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে সিট না পেলেও ছাত্রলীগের ছাত্রছায়ায় হলে থাকছে বহিরাগতরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, শহীদ হবিবুর হলের ৪০৫ নম্বর কক্ষে প্রায় তিন মাস ধরে অবৈধভাবে থাকছেন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিক। আইন অনুষদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল ইসলামের ছত্রছায়ায় হলে থাকছেন তিনি।
এ বিষয়ে মিনহাজ বাংলানিউজকে বলেন, ‘সাদিক মাস দেড়েকের মতো হলে থাকছে। হল প্রাধ্যক্ষকে জানিয়ে তাকে রাখা হয়েছে। ’ তবে তবে প্রাধ্যক্ষ জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বাংলানিউজকে জানান, মিনহাজের সঙ্গে এ বিষয়ে তার কথাই হয়নি।
এছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ২৩২ নম্বর কক্ষে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে থাকছেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী মো. সাগর।
ছাত্রলীগ প্যাকেজ
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে হলে সিট বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এক্ষেত্রে রয়েছে ‘ছাত্রলীগ প্যাকেজ’। দুই সিট ও চার সিটের কক্ষের জন্য রয়েছে আলাদা প্যাকেজ। সিটের ভিত্তিতে ২-৩ হাজার টাকা আদায় করে সিট দেওয়া হয়। ফাঁকা সিট খুঁজে আগেই দখল নিয়ে রাখেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশাপাশি দলীয় কর্মীদের কাছ থেকেও সিটের বিনিময়ে টাকা আদায় করেন নেতারা। ছাত্রলীগের উপ-প্রচার সম্পাদক বাবর শের-ই বাংলা হলে এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তিন হাজার টাকায় সিট বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হল প্রাধ্যক্ষ বাংলানিউজক বলেন, গায়ের জোরে কিংবা দল ভারি করা যাই হোক না কেন নেতাকর্মীরা হলগুলোতে এসব করে যাচ্ছেন। যারা অবৈধ, তাদের হল থেকে বের করে দিতে গেলে বিভিন্নভাবে বাধা আসে। ফলে আমরা অসহায়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দু-একদিনের মধ্যেই হলের দায়িত্বে থাকা নেতাকর্মীদের নিয়ে বসবো। হলগুলোতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি যেন বজায় থাকে আমরা সেই চেষ্টাই করবো।
হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক রেজাউল করিম বকসী বাংলানিউজকে বলেন, আগামী দু-একদিনের মধ্যেই উপাচার্যের সঙ্গে হল প্রাধ্যক্ষরা দেখা করবে। এগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯
এনটি/এইচএ/