ঢাকা: সিঙ্গাপুরে শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত শ্রেণিকক্ষ শিক্ষকরাই শিক্ষা প্রশাসনের সকল দায়িত্ব পালন করছেন। তদারকি করার জন্য অন্য কোনো পেশার কর্মীদের এখানে অন্তর্ভূক্ত করা হয় না।
শনিবার বিকেলে বিসিএস এডুকেশন একাডেমি ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার উন্মুক্ত মঞ্চ-এর উদ্যোগে ‘শিক্ষায় মডেল রাষ্ট্রের সন্ধানে প্রসঙ্গ সিঙ্গাপুর’ শিরোনামে একটি আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে এতথ্য জানানো হয়। এটি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত উদ্যোক্তাদের ধারাবাহিক ওয়েবিনারের প্রথম দিন।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। বিশেষ অতিথি ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজশাহী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ওয়াসীম মো. মেজবাহুল হক। প্রবন্ধের সহ-লেখক বৃন্দাবন সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক জিয়া আরেফিন আজাদ, কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের শেরিডান কলেজের অধ্যাপক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ড. এ কে এম খায়রুল ইসলাম, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচারাল ফাউন্ডেশন বাংলা স্কুলের অধ্যক্ষ রুবাবা ইসলাম সাবেদ বক্তব্য রাখেন।
বিসিএস সধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সহকারী অধ্যাপক ড. কাজী জাকির হোসেনের সঞ্চালনায় বৃন্দাবন সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সুভাষ চন্দ্র দেব এবং সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রাজু আহমেদ র্যাপোর্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাগত বক্তব্যে জিয়া আরেফিন আজাদ সিঙ্গাপুরকে কেন মডেল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর জাতির জনকের উদ্যোগে প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড সার্ভিসের রি-অর্গানাইজেশন কমিটি (এএসআরসি ১৯৭৩)’র প্রতিবেদন, ২০০০ সালে জনপ্রশাসন সংস্কারে শামসুল হক কমিশনের রিপোর্টে সেই পরামর্শ রয়েছে। ‘একুশ শতকের জনপ্রশাসন’ নামের প্রতিবেদন, ইউএনডিপি প্রণীত ‘পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সেক্টর স্ট্যাডি রিপোর্ট, ১৯৯৩’ এবং বিশ্বব্যাংকের প্রনীত ‘রিফর্মিং দ্য পাবলিক সেক্টর, ১৯৯৬’ প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের অভিন্নতার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখান সিঙ্গাপুরে শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত শ্রেণিকক্ষ শিক্ষকগণই শিক্ষা প্রশাসনের সকল দায়িত্ব পালন করছেন। তদারকি করার জন্য অন্য কোনো পেশার কর্মীদের এখানে অন্তর্ভূক্ত করা হয় না। শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের শিক্ষার দুর্দশার অন্যতম কারণ।
প্রবন্ধকার প্রফেসর ড. ওয়াসীম মো. মেজবাহুল হক সিঙ্গাপুরের শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তারিত তুলে ধরেন। সিঙ্গাপুরে একজন প্রার্থী আমাদের দেশের মতো উচ্চ শিক্ষা শেষে শিক্ষকতায় প্রবেশ করেন না। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর একজন প্রার্থী তার পেশা বেছে নেন। কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে শিক্ষকতার জন্য যিনি নির্বাচিত হন রাষ্ট্র তাকে শিক্ষক হিসেবে নির্মাণের জন্য ছয় বছরের পড়াশুনা, প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্তি ও গবেষণার ব্যবস্থা করে দেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা সার্ভিসের একজন সদস্য একইসঙ্গে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে তার ক্যারিয়ারের গতি নির্ধারিত হয় পছন্দ ও যোগ্যতা অনুসারে। প্রথম তিন বছরের বাধ্যতামূলক শ্রেণিকক্ষ শিক্ষকতার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে আন্তঃযাতায়াতের সুযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে মেধার মূল্যায়ন, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ ও যত্নের কারণে সিঙ্গাপুর আজ এই ফল পেয়েছে। সেখানে শিক্ষকদের কাজে সন্তুষ্টি রয়েছে।
আলোচক ড. এ কে এম খায়রুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষায় অতি নিম্ন ব্যয় করা হয় যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন (জিডিপির ১.৮ ভাগ)। আমাদের শিক্ষক নিয়োগেও মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। তিনি এ দু’টি বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন। পেশাগত সন্তুষ্টির বিষয়টিও নিস্পত্তি করতে হবে যাতে মেধাবিদের আকৃষ্ট করা যায়।
সিঙ্গাপুরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রুবাবা ইসলাম সাবেদ সিঙ্গাপুরে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায়োগিক দিকগুলো তুলে ধরেন। কোভিড সংক্রমণের সময় সিঙ্গাপুর কীভাবে কাজ করছে তিনি তা ব্যাখ্যা করেন।
বিশেষ অতিথি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশগুলোর শিক্ষা মডেল নিয়ে তার পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরেন এবং সিঙ্গাপুরের শিক্ষা ব্যবস্থার শক্তির দিকগুলো ফোকাস করেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো ব্যাখ্যা করেন। মেধার মূল্যায়নের জন্য তিনি শিক্ষকদের পদোন্নতিতে কিছু ভিন্ন শর্ত আরোপের সুপারিশ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ হচ্ছে তবে প্রগতির গতি যথেষ্ঠ শ্লথ। ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ যে উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিল তার কতটুকু আজ অনুসৃত হচ্ছে তিনি সেটি পূনর্মূল্যায়নের তাগিদ দেন। শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য গবেষণার উপর গুরুত্বারোপ করেন। পেশা হিসেবে শিক্ষকতায় গতি আনার জন্য মধ্যবর্তী মূল্যায়ন ও পেশায় বিভিন্ন শাখায় আন্তঃযোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় কি না সেটা দেখা দরকার। তিনি প্যানডেমিকের এই কঠিন পরিস্থিতিতে বিকল্প পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন পথ খুলে দেওয়া জন্য তিনি শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ সময়: ০০২১ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০২১
এমআইএইচ/এসআইএস