জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি): দেশের ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (৩০ জুলাই) দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত বিজ্ঞান ইউনিটের ১০০ নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী কেন্দ্র হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে পছন্দের তালিকায় রেখেছিলেন তাঁদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজধানীর নয়টি উপকেন্দ্রে আসন বিন্যাস করা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ৯টি কেন্দ্রে ৬৪ হাজার ৪শ ৫৮ জন অংশ নেন।
বাকি কেন্দ্রগুলো হলো— ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্স, ইডেন মহিলা কলেজ, নটরডেম কলেজ, ভিকারুন্নেছা নুন স্কুল এন্ড কলেজ, (ভবন-১, গেইট-১) এবং ভিকারুন্নেছা নুন স্কুল এন্ড কলেজ, (ভবন- ২, গেইট- ৮)।
দেশের ১৯ কেন্দ্রে ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। অন্যান্য কেন্দ্রের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও সকাল থেকে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর ছিল। এদিকে সার্বিক শৃঙখলা রক্ষায় তৎপর ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আশেপাশে মোতায়েন ছিল পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য। একই সাথে রেঞ্জার ইউনিট, বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোও পরীক্ষার্থীদের সহায়তায় সচেষ্ট ছিল। পরীক্ষা ১২টায় শুরু হলেও শনিবার সকাল ৯টা থেকেই ভর্তিচ্ছুরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট, দ্বিতীয় গেইট, তৃতীয় গেইট এবং পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের গেইট দিয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশে সুযোগ করে দেওয়া হয়। প্রবেশপথের পাশেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সহায়তা ডেস্ক ছিল। যেখান থেকে ভর্তিচ্ছুরা পরীক্ষা রুম ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
ভিন্ন কেন্দ্রের ৮০ ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেন জবিতে:
এদিকে অন্য উপকেন্দ্রের প্রায় ৮০ জন পরীক্ষার্থী ভুলবশত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলে মানবিক দিক বিবেচনায় তাঁদের পরীক্ষাও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি রুমে সেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাপনায়।
শর্ট সিলেবাসের বিষয়ে ভর্তিচ্ছুকদের অভিযোগ:
পরীক্ষার প্রশ্ন এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার সিলেবাসের আলোকে করার কথা বলা হলেও পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে প্রশ্ন করা হয়েছে বলে ভর্তিচ্ছুরা অভিযোগ করেছেন। ভর্তিচ্ছুরা অভিযোগ করে বলেন, করোনার কারণে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা সংক্ষপ্তি সিলেবাসে হয়েছে। গুচ্ছ কমিটিও এই সিলেবাসেই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করবেন বলে জানিয়েছেন। আমরাও এ সিলেবাসে প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখি, পূর্ণাঙ্গ সিলেবাস থেকেই বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ক’ ইউনিটের প্রশ্ন হয়েছে। শর্ট সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন হওয়াতে বেশ সমস্যাই হয়েছে। তবুও, স্টান্ডার্ড মানের প্রশ্ন ছিল। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস থেকে প্রশ্ন হলে পরীক্ষা আরও ভালো হতো। শিক্ষার্থী জানান, উচ্চতর গনিত বিষয়ে ৪০-৫০% প্রশ্ন শর্ট সিলেবাসের বাইরে ছিল। এছাড়াও পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান বিষয়েও অনেক প্রশ্ন শর্ট সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে রসায়ন বিষয়ে শর্ট সিলেবাস থেকে প্রশ্ন করা হয়।
কেন্দ্র এলাকায় যানজটে ভোগান্তি:
পুরান ঢাকার যানজটের জন্য যাতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি না হয় যানজট নিরসনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে চিঠি দেওয়া হলেও তার তেমন কার্যকারিতা চোখে পড়েনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামনে ও আশেপাশের এলাকায় যানজট ছিল। যাতে করে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কিছুটা ভোগান্তি হয় কেন্দ্রে পৌঁছাতে। এতে একাধিক শিক্ষার্থীকে নির্ধারিত সময়ের পরও কেন্দ্রে ডুকতে দেখা যায়।
অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া:
গুচ্ছের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অভিভাবকরা। উত্তরা থেকে আসা নাসিমা আক্তার বলেন, মেয়েকে নিয়ে সেই সকালে রওনা দিয়েছি। ১২টা থেকে পরীক্ষা শুরু হলেও পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছেছেন সকাল ১০টার দিকে।
তিনি বলেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা আমাদের মতো অভিভাবকদের মুক্তি দিয়েছে চরম ভোগান্তি থেকে। এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা একটা পরীক্ষা দিলেই ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়। এটা আমাদের আর্থিকভাবে অনেকটা স্বস্তির। অন্যদিকে মিরপুর থেকে ছেলেকে নিয়ে পরীক্ষার হলে আসছেন জামিল হোসেন নামে আরেক ব্যক্তি।
এই অভিভাবক আরও বলেন, এ পদ্ধতি একদিকে পরীক্ষার্থী ও আমাদের মতো অবিভাবকদের ভোগান্তি লাঘব ও আর্থিকভাবে সাশ্রয় করলেও অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীদের মাঝে তৃপ্তি ও হতাশার কাজ করে। কারণ, এ একটি পরীক্ষা দিলে একসাথে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়া হয়ে যায়। কিন্তু সেই একটি পরীক্ষাই যদি কোনো কারণে খারাপ বা দিতে মিস করে তাহলে সে ছেলেটি এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে পারবে না। আবার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও পছন্দের বিভাগে ভর্তি হওয়াটাও ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।
প্রশ্নপত্র নিয়ে প্রশ্ন:
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে খোদ শিক্ষকরাই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগী অধ্যাপক জগদীশ চন্দ্র সরকার বলেন, প্রশ্নপত্রের গেটাপ দেখে আমরা পুরোপুরি হতাশ। আমার চোখের আন্দাজ প্রশ্নের ফন্ট সাইজ ছিল অতি ক্ষুদ্রকার। ৮-৯ মানের। স্পেস মাত্র ১, মার্জিন ০.২। উত্তরের অপশনগুলো (ধ-ফ) পাশাপাশি দেওয়া। প্রশ্নপত্রের কোথাও তিল পরিমান ফাঁকা জায়গা নেই। আবার কোনো আলাদা কাগজও দেওয়া হয়নি পদার্থ, গণিত, রসায়ন রাফ করার জন্য। আমার আশংকা অনেক ভর্তি পরীক্ষার্থী বিভিন্ন রকম ভুল করেছে শুধুমাত্র এরকম একটা ঘিঞ্জি প্রশ্নপত্রের কারণে। একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্নপত্রের গেটাপটাও আজ আমরা আপ টু দ্য মার্ক করতে পারি না?
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হোসনে আরা জলি বলেন, ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এমন সাইজের অ্যালফাবেট এ এমন হিজিবিজি প্রশ্ন কখনো দেখিনি। এত ছোট সাইজের ফন্টে প্রশ্ন করা এবং সাইন্সের অংকের রাফ করার জন্য সামান্যতম ফাঁকা জায়গা না রাখার কারণ কী? এমন প্রশ্নের কারণে পরীক্ষার্থীরা কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং অন্যরা কতোটা লাভবান হলো? এই শিক্ষার্থীরাই যদি হয় জাতির ভবিষ্যত আর যদি শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড হয়, তাহলে সত্যিই ভেবে দেখার বিষয়! কিন্তু ভাবার কেউ কি আছে?
পরীক্ষার ফলাফল:
ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, খাতা মূল্যায়নের জন্য ৩ আগস্ট পর্যন্ত সময় পাবে টেকনিক্যাল কমিটি। ৩ আগস্টের মধ্যে ফল তৈরি করে কোর কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। এরপর কোর কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে ফল প্রকাশ করা হবে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটির আহবায়ক এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার বলেন, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ‘ক’ ইউনিটের ফল প্রকাশ করবো। ফল তৈরির জন্য আমাদের ৩ আগস্ট পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। আশা করছি এর আগেই ফল তৈরির কাজ শেষ হবে। এরপর গুচ্ছের মূল কমিটি ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেবে।
পরীক্ষার সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক। তিনি জানান, গতবারে আমাদের আসন নিয়ে যে সমস্যাগুলো হয়েছিল, এবারে কষ্টের বিনিময়ে হলেও আমরা সমাধানের চেষ্টা করেছি। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নটরডেম কলেজসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে আমরা পরীক্ষা নিয়েছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন নির্ধারিত ৬৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের এই উদ্যোগ। ঢাকার বাইরে অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতে খবর নিয়েছি। সুষ্ঠু পদ্ধতিতে পরীক্ষা সংঘটিত হয়েছে।
গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় হলো:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় (নেত্রকোনা), বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (গোপালগঞ্জ), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় (কিশোরগঞ্জ) এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রসঙ্গত, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে দেশের ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতিতে অংশ নিলেও এবার নতুন যুক্ত হয়েছে কিশোরগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
আগামী ১৩ আগস্ট মানবিক বিভাগ (বি) এবং ২০ আগস্ট বাণিজ্য বিভাগের (সি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সব পরীক্ষাই দুপুর ১২টায় শুরু হয়ে ১টায় শেষ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২২
এমজেএফ