ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

ফুলের মালা গলায় নিয়ে ফিরলেন সেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০২২
ফুলের মালা গলায় নিয়ে ফিরলেন সেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

নড়াইল: অবশেষে কর্মস্থলে ফিরলেন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস।
 
১৮ জুন লাঞ্ছিত হওয়ার পর থেকেই নিজেকে আত্মগোপনে রেখেছিলেন তিনি।

৪৬ দিন পর বুধবার (৩ আগস্ট) সকাল ১১টায় তিনি নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্যের গাড়িতে করে কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন।
 
এসময় তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। পরে দুপুর ১টার দিকে সবার উপস্থিতে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়।
 
এসময় উপস্থিত ছিলেন নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বোস , সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ওই কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অচিন চক্রবর্তি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজার আব্দুস সালাম হাওলাদার, রেজিস্ট্রার মাহফুজ আল হাসান, পরিচালক মনিটরিং ও মূল্যায়ন মো. রফিকুল ইসলাম, পরিচালক আইন ও বিচার দপ্তর মো. ছিদ্দিকুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা এম এ মতিন, কলেজ পরিচালনা পর্ষদের অন্যান্য সদস্য, বিছালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হেমায়েত হোসেন ফারুক, সাবেক চেয়ারম্যান আনিচুর রহমান, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুর রহমানসহ কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং গণমাধ্যম কর্মীরা।
 
গত ২৪ জুলাই থেকে কলেজের প্রশাসনিক কার্য্যক্রম চালু হলেও ২৫ জুলাই থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠদান শুরুর মাধ্যমে কলেজ চালু হয়েছে। তখনও কলেজে আসেননি অধ্যক্ষ। তবে ধীরে ধীরে কলেজে আসতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা, স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে কলেজের কার্যক্রম। কলেজ ক্যাম্পাসে এখনো পুলিশ মোতায়ন রয়েছে।
 
এদিকে অধ্যক্ষকে কলেজে পেয়ে আনন্দিত শিক্ষক, শিক্ষার্থীরাসহ সংশ্লিষ্টরা।
 
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার আব্দুস সালাম হাওলাদার বলেন, কলেজের এ ঘটনা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করেছে। আমরা আজ অধ্যক্ষকে তার নিজের পদে বসিয়ে দিতে এসেছি। তিনি যেন তার মেধা-মনন দিয়ে শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে পারেন, আপনাদের কাছে সেই সহযোগিতা কামনা করছি।
 
সদর থানার ওসি মাহমুদুর রহমান বলেন, ওইদিনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী হিসেবে বলতে চাই, ভিডিও ফুটেজ দেখে ও তদন্ত করে অপরাধীদের গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলছে। অপরাধীদের কেউ ছাড় পাবে না। তবে নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার হবে না।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বোস বলেন, নড়াইলে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান হবে না। অধ্যক্ষকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে বীরের বেশে কলেজে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি সংসদ সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
 
সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনায় যে মানসিক ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা হয়তো আমার পূরণ করতে পারব না। তবে আজ তাকে আমরা বরণ করে নিয়ে বলতে চাই, আমরা সবাই তার পাশে আছি। সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা কখনো প্রশ্রয় দেইনি আর দেবও না। এমন ঘটনা ঘটায় তিনি অধ্যক্ষসহ সবার কাছে সবার পক্ষ থেকে ক্ষমা চান।
 
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার জীবনে যা ঘটে গেছে, তার ক্ষতি অপূরণীয়। আমি আত্মগোপনে ছিলাম, কারণ ভয়ে-লজ্জায় আমি সামনে আসতে পারিনি। ভয় হয়েছিল, হয়তো কোনো মা তার শিশুকে বলবে, দেখ, ওই শিক্ষককে জুতার মালা পরানো হয়েছিল।
 
এসময় তিনি আবেগ প্রবণ হয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি আরও বলেন, আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার স্ত্রী ও সহকর্মী হুমায়ুন কবীর রিন্টু আমাকে ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিয়ে রেখেছে। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।  
 
কি ঘটেছিল সেদিন
সদরের মির্জাপুর কলেজে রাহুল দেব নামের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের নুপুর দেবকে সমর্থন করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এ পোস্ট দেওয়ার পর ১৮ জুন সকালে কলেজে আসেন রাহুল। এরপর তার বন্ধুরা পোস্টটি মুছে ফেলতে বললেও পোস্ট মোছেননি রাহুল। শিক্ষার্থীরা বিষয়টি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জানান। একপর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কলেজের সব শিক্ষকদের পরামর্শে রাহুলকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে কলেজ চত্বরে থাকা শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জসহ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ছোড়ে। এ ঘটনার সময় দুই পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১০ জন আহত হন। এসময় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। একপর্যায়ে পুলিশ ও কর্মকর্তাদের সামনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর গলায় জুতার মালা পরিয়ে কলেজ থেকে বের করা হয়।
 
ঘটনার পরদিন থেকেই কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে সেখানে পুলিশের পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। ১৭০/১৮০ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। অভিযুক্ত নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত খুলনা বি এল কলেজের এক ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। এদিকে অভিযুক্ত রাহুলের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। তার বাড়িতে ও অধ্যক্ষ স্বপন কুমারের বাড়িতে পুলিশের সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।