যাত্রাদলে অভিনয় চলাকালীন যাত্রা অভিনেতাদের জন্য সংলাপ (ডায়লগ) বলে সহায়তা করে থাকেন যিনি, প্রতিষ্ঠানিক ভাবে তিনি ‘প্রমটার বা মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত। খালি গলায় উচ্চস্বরে সঙ্গে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে যাত্রা মঞ্চ’র পাশে বাদ্যযন্ত্র বাদকের সঙ্গে বসে কার্য সম্পন্ন করতে দেখা যায় তাদের।
সম্প্রতি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাত দিনব্যাপী যাত্রা উৎসব। যেখানে চন্দন সাহার প্রদর্শন ছিল অনন্য। যদিও শিল্পীদের ভীড়ে যাত্রাপালার এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা থেকে যান অন্তরালেই।
দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে যাত্রাপালা’র সঙ্গে কাজ করছেন চন্দন সাহা। ১৯৬৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার শিবলয় থানা আরিচা ঘাট এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা-মা দুজনেই যুক্ত ছিলেন ছিলেন যাত্রা শিল্পের সঙ্গে, অভিনয় করতেন নায়ক ও নায়িকার চরিত্রে। তবে কাজের ক্ষেত্রে বাবা পরিমল কুমার সাহা’র কাছ থেকেই বেশি উৎসাহ পেয়েছেন।
চন্দন সাহা জানান, স্কুল ছুটির সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যেতেন বিভিন্ন পালায়। সেখান থেকেই দেখে দেখে প্রমটারের কাজটা রপ্ত করেছেন তিনি। সাল ১৯৮৮, সেই সময় আনন্দময়ী অপেরা যাত্রাদলের মালিক ছিলেন ধরিন্দ্রনাথ গোস্বামী, তার ছেলে স্বপন গোস্বামী ছিলেন চন্দন সাহার বন্ধু। চা খেতে খেতে একদিন স্বপন বলেলেন, ‘তুমি শিক্ষিত ছেলে আমাদের দলের মাস্টারের দায়িত্বটা নাও। আমি চাই তুমি আমাদের দলকে নিজের দল মনে করে যোগ দাও, শিক্ষিতদের সম্মানের কাজটাই করা উচিত। ’ কয়েকদিন ভেবে আনন্দময়ী অপেরা যাত্রাদলে যোগদান করা। সেই থেকে চলছে।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে এই প্রমটার জানান, প্রথমবার যাত্রার মঞ্চে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি, ফলে কিছু ভুল করে ফেলেন। এজন্য পরিচালকের অনেক কটূকথা শুনতে হয়েছে। এতে ভেঙে পড়েননি বরং নিজেকে আরও ভালো কাজের জন্য প্রস্তুত করেছেন। একটা সময়ে গিয়ে সেই পরিচালকই উল্টো বাহবা দিয়েছেন তাকে।
প্রমটারের কাজের পাশাপাশি অনেকে পালায় অভিনয়ও করেছেন চন্দন সাহা। বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে দলের সুবিধার্থে অনেক পালায় অংশ নিয়েছেন তিনি। অভিনয়ের শুরুর বিষয়ে চন্দন সাহা জানান, একদিন বিটিভিতে ঐতিহাসিক পালা ‘দেবী সুলতানা’য় মাস্টারি করতে গিয়েছিলেন। সেদিন কোন একটা সমস্যার কারণে ওই পালার পরিচালক মেকআপ রুমে ঢুকে আমাকে খুঁজতে থাকেন। হটাৎ করে অনুরোধ করে বসেন মুস্তাক আলী চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। সেই থেকে প্রমটারের পাশাপাশি অভিনয়ও শুরু করেন তিনি।
চন্দন সাহা বলেন, বহু যাত্রাদলে কাজ করেছি, একদলে তিন-চার বছর কাজ করার পরও মালিকরা ছাড়তে চাইতেন না। কোন যাত্রাদল থেকে যোগ্য সম্মানী না দিলেও কারও হুট করে কাজ ছেড়ে দিয়ে দলকে বিপদে ফেলেনি। জীবিকার টানে যদি বাধ্য হয়ে ছাড়তে হত, তখনও সেই দলে আরেকজন মাস্টার নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত কাজ করে গেছি।
এক সময় বছরের সাত থেকে আট মাস যাত্রার মৌসুম ছিল। সেটা বর্তমানে তিন মাসে অর্থাৎ শুধু শীতের সময়ে চলে এসেছে। তাছাড়া কিছু নির্দিষ্ট স্থানে যেমন; বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার, চারুকলা বা শিল্পকলা একাডেমি’তে অল্প কিছু যাত্রাপালা হয়ে থাকে গরমকালে।
বর্তমানে যাত্রাশিল্পী প্রায় ধ্বংসের পথে। এর কারণ জানিয়ে প্রমটার চন্দন সাহা বলেন, অশ্লীলতাই ধ্বংস করেছে যাত্রা সংস্কৃতিকে। মানুষ মনে করে থাকেন যাত্রাদলের শিল্পীরা অথবা মালিকরা এই অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, আসলে তা নয়। যাত্রাপালায় নায়েক পার্টি থাকে সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় আয়োজক কমিটি, তাদের আমন্ত্রণে যাত্রাদল পারফর্ম করতে যায় বিভিন্ন স্থানে। তখন এই আয়োজক কমিটি অধিক ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাইর থেকে কিছু নারী ভাড়া করে নিয়ে আসে যা তারা যাত্রাদলের শিল্পী বলে মানুষের কাছে প্রচার করে থাকে। যার ফলে উৎসুখ জনগণ শিল্পীদের অশ্লীলতা মনে করে ভীড় লাগিয়ে দেয়, অথচ আমাদের কোন শিল্পীই অশ্লীলতার সঙ্গে জড়িত নয়। এই যাত্রা কমিটির অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে সম্মানহানী হচ্ছে আমাদের গোটা সমাজে। মূলত এই নায়েক পার্টিই অশ্লীলতার বাহক।
কিছুদিন আগে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে শেষ হলো যাত্রা উৎসব। বহুদিন পর ঢাকায় উন্মুক্তভাবে মুক্তমঞ্চে যাত্রাপালার আয়োজন কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে চন্দন সাহা বলেন, বর্তমান শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একটি সময়উপযোগী চিন্তা তিনি নিজে থেকেই করেছেন সংস্কৃতি বাঁচাতে। শিল্পকলার মহাপরিচালক বলেছেন; ‘যাত্রা কোন চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকতে পারে না, যাত্রা হবে মুক্ত মঞ্চে’। সরকার যেভাবে উদ্যোগ নিয়ে আমাদের সাহায্য করছে তাতে আমরা অত্যন্ত খুশি। যে অনুষ্ঠানটা করেছি এটা শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ও সরকারের অবদান, তারা না থাকলে হত না। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। আমাদের সকল শিল্পীর তরফ থেকে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি রইলো শুভ কামনা। তাছাড়া বাংলানিউজ২৪.কম এর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা আমার মতো ছোট মাপের মানুষের জন্য তাদের সময় ব্যয় করার জন্য। সকল সাংবাদিকের কাছেই আমরা কৃতজ্ঞ এভাবে দিনের পর দিন আমাদের যাত্রা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টায় প্রচারণা করার জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২৪
এমআরইউসি/এনএটি