ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

চার দশকে মুক্তিযুদ্ধের চল্লিশটি ছবি নেই

বিপুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১০
চার দশকে মুক্তিযুদ্ধের চল্লিশটি ছবি নেই

শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্র। দেশের গণমানুষের চালচিত্র ফুটে উঠে চলচ্চিত্রে।

বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কীর্তি মুক্তিযুদ্ধ তাই স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের চলচ্চিত্রে উঠে আসার কথা। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রে তার খুব উজ্জ্বল প্রতিফলন নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বিগত প্রায় চার দশকে চল্লিশটি মুক্তিযুদ্ধের ছবিও নির্মিত হয়নি। তবে প্রামাণ্যচিত্র এই হিসাবের বাইরে।

আবার গর্ব করার মতো বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এ দেশে স্বাধীনতার ইঙ্গিত নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় নির্মিত হয়েছে একাধিক প্রামাণ্যচিত্র। তাই মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নিয়ে একদিকে রয়েছে আক্ষেপ, অন্যদিকে অহংকার।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর এ দেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান প্রতীকীভাবে নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেওয়া’। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবিতে একগোছা চাবির মধ্য দিয়ে শাসনক্ষমতা বোঝানো হয়। সিম্বলিক ফিল্ম হলেও এখানে যুক্ত হয়েছে প্রভাতফেরির রিয়েলস্টিক দৃশ্য, যা আমাদের চেতনার অংশ। মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বাধীনতার বাণী নিয়ে নির্মিত হয়েছিল আরো একটি ছবি। ১৯৭০ সালে নির্মিত ফখরুল আলম পরিচালিত ‘জয়বাংলা’ নামের ছবিটি পাকিস্তানি সেন্সর বোর্ড আটকে রাখে। ১৯৭২ সালে এটি মুক্তি পায়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বের এ দুটো ফিচার ফিল্মের নাম তাই উল্লেখ করতেই হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ছুটেছেন জহির রায়হান ও আলমগীর কবির। জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ নামের দুটো ডকুমেন্টারি ফিল্ম। আলমগীর কবির তৈরি করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’। এছাড়া বাবুল চৌধুরী ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’ নামে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন। এসব প্রামাণ্য ছবিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা, গণহত্যা, শরণার্থী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, মুজিবনগর সরকারের তৎপরতাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব গণমত সৃষ্টিতে এসব প্রামাণ্যচিত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় দিনলিপি সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করার ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু করেন বেশ কজন নির্মাতা। মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম ছবি চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবির কাহিনীতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার অদম্য সাহসিকতা ও দেশমাতৃকার জন্য জীবনপণ লড়াইয়ের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবচিত্র তুলে ধরতে পরিচালকের আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায় এ ছবিতে।

১৯৭২ সালে মুক্তি পায় আরো বেশ কটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি। এর মধ্যে অন্যতম সুভাষ দত্ত নির্মিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, আনন্দ পরিচালিত ‘বাঘা বাঙালি’, মমতাজ আলী পরিচালিত ‘রক্তাক্ত বাংলা’ প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধের ছবি হলেও এগুলোতে বাণিজ্যিক উপদান ছিল লক্ষণীয়। বিশেষ করে হিন্দি ছবির ভিলেনের মতোই এগুলোতে পাকস্তানি সৈন্যদের উপস্থাপন করা হয়েছে। নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার পরিবর্তে তাদের সামনে মদের বোতল আর নৃত্যরত বঙ্গরমণী দিয়ে পুরো পরিস্থিতিকে হালকা করা হয়েছে।

প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির ১৯৭৩ সলে নির্মাণ করেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’। এতে চলচ্চিত্রকার কাহিনীর সঙ্গে মিল রেখে মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ সরাসরি সার্থকতার সঙ্গে ব্যবহার করেন। একই বছর আরো কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি হয়েছে। এর মধ্যে আছে খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’, কবীর আনোয়ারের ‘শ্লোগান’, আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ প্রভৃতি। এসব ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কার পরিস্থিতি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ করে খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে আলাদা আবেদন তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ফুটে ওঠে ১৯৭৪ সালে নির্মিত নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ ছবিতে। ওই বছর  মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’ ও এস আলীর ‘বাংলার ২৪ বছর’।

১৯৭৪-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণে ভাটা পড়ে। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় হারুন-অর-রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’। এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি পর্দায় না এনে যুদ্ধের মানবিক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া আবদুস সামাদের  ‘সূর্যগ্রহণ’ ছবিতেও এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে চলচ্চিত্র নির্মাণের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণ কমে যাওয়ায়। আশির দশকের শুরুতে কয়েক বছর বিরতির পর আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি উপহার দেন শহীদুল হক। ১৯৮১ সালে মুক্তি পায় তার ‘কলমীলতা’ ছবিটি। তারপর লম্বা বিরতি।

আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের চলচ্চিত্রের অধঃপতন শুরু হয়, যা অব্যাহত থাকে পুরো নব্বই দশক পর্যন্ত। এ সময়টার মাঝেই বিকল্পধারা হিসেবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বলিষ্ঠ হয়ে উঠে। স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবিতে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রাধান্য ছিল বরাবরই। মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’, তানভীর মোকম্মেলের ‘হুলিয়া’ ও ‘নদীর নাম মধুমতি’, নাসিরউদ্দিন ইউসুফের ‘একাত্তরের যীশু’, মোস্তফা কামালের ‘প্রত্যাবর্তন’, আবু সাইয়ীদের ‘ধূসর যাত্রা’ প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্যরে আলোচিত ছবি।

একাত্তরে মার্কিন সাংবাদিক লিয়ার লেভিনের ধারণ করা ফুটেজ নিয়ে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন প্রামাণ্য ছবি ‘মুক্তির গান’। ছবিটি দেশজুড়ে  প্রশংসিত হয়। কয়েকটি শিশুতোষ মুক্তিযুদ্ধের ছবি এ সময় নির্মিত হয়। যার মধ্যে দেবাশীষ সরকারের ‘শোভনের একাত্তর’, রফিকুল বারী চৌধুরীর ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’, জাঁ-নেসার ওসমানের ‘দুর্জয়’, হারুনুর রশীদের ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’,  বাদল রহমানের ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’, ছটকু আহমেদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন’, মান্নান হীরার ‘একাত্তরের রঙপেন্সিল’ উল্লেখযোগ্য।

লম্বা বিরতির পর ১৯৯৪ সালে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসেন। নিজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে তার পরিচালনায় নির্মিত প্রথম ছবি ‘আগুনের পরশমণি’। ১৯৯৮ সালে নির্মিত হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় ছবি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক না হলেও এতে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৯৮ সালে নির্মাণ করেন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। এই পরিচালক ২০০৪ সালে কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি করেন ছবি ‘মেঘের পর মেঘ’। ২০০৪ সালে আরো দুটো উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মিত হয়। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তৈরি করেন ‘শ্যামলছায়া’ এবং অভিনেতা তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন ‘জয়যাত্রা’। দুটো ছবিতেই মুক্তিযুদ্ধের খন্ড খন্ড চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

আবার কয়েক বছর বিরতির পর চলতি বছর মুক্তিযোদ্ধা নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ‘গেরিলা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের ছবির কাজ শুরু করেন। সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে এ ছবির চিত্রায়ণ শেষ হলেও আনুষঙ্গিক কাজের জন্য এ বছর মুক্তি পাচ্ছে না। একইভাবে মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে শাহজাহান চৌধুরী নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ অল্প কিছু অংশের শুটিং শেষ না হওয়ার কারণে এ বছর মুক্তি পাচ্ছে না। অর্থাৎ গত কয়েক বছরের মতো চলতি বছরও আমাদের থাকতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রবিহীন।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এক মহাকাব্য। এই কাব্যের খ-িত চিত্রই এখন পর্যন্ত নির্মিত ছবিগুলোতে ফুটে উঠেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি মহৎ চলচ্চিত্র দেখার প্রত্যাশায় আজও প্রহর গুনছেন দেশের মানুষ। কিন্তু যে হারে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ কমে যাচ্ছে, তাতে আগামী বছরগুলোতে কয়টি মুক্তিযুদ্ধের ছবি পাওয়া যাবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮৫৫, ডিসেম্বর ১৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।