একটা গল্পের পুরোটাই যখন থাকে ঘটনাবহুল, টান টান উত্তেজনায় ভরা, তখন সেই গল্পের শুরু করা আর শেষের রেখা টানা কষ্টের। শনিবারের সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে যাকিছু ঘটে গেলো তা তেমনই একটা ছোটগল্প।
শেষ নয়, বলা যায় এখানেই শুরু। কারণ আয়োজকরা ঘোষণা দিয়েছেন এমন আয়োজন চলবে হর বছর।
বেশতো। কিন্তু এবারের আয়োজনের তৃতীয় ও শেষ দিনের গল্পটাও ছিলো দারুণ। প্রথম দুই দিনের মতোই জমজমাট। হয়তোবা তার চেয়েও বেশি।
শুরু হয় জলের গানে। শুরুর দিকটা নয়, ওদের শেষটা দিয়েই শুরু করা যাক। এক কথায় বলা যায় জলের গানের রাহুল আনন্দের বুকে দম আছে। বলারই কী? টানা দুই মিনিট একশ্বাসে শঙ্খ বাজিয়ে সে প্রমান তো তিনি হাজার কয়েক দর্শকের সামনেই তুলে ধরলেন। তবে তার আগে জলের গানে, ফুলের গানে, পাখির গানে আর ঝরা পাতার গানে মাতালেন গোটা আসর। জলেই জমলো গানের সন্ধ্যা। রাহুল আনন্দ নেচে গেয়ে মাতালেন সবাইকে। পুরো দলের অন্য সদস্যদের বেশভুষায় সাধারণের মাঝেই কিছুটা ভিন্নতার ছোঁয়া। সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে রাহুলকেও মানাচ্ছিলো বেশ। জলের গানের দলের সব সদস্যের গানের গলা আছে সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রত্যেকের হাতে যে বাদ্যযন্ত্রগুলো, সেগুলোতে তুন আর ধুন তারা যেভাবে তুলেছেন তাতে বাদ্যেও তারা সেরা সেকথা বলা মোটেই বাহুল্য হয়। বাদ্যযন্ত্রগুলোর চেহারায়ও ভিন্নরূপ দেখা গেলো। পুরো পরিবেশনাটি ছিলো ছন্দময়। অসাধারণভাবে ধারাবাহিক। একটির সঙ্গে অন্যটির জোরা লাগিয়ে লাগিয়ে জলের ধারার মতো এগিয়ে গেলো জলের গান। দর্শককে ধন্য ধান্য পুষ্পে ভরা... গাইয়ে আর পরবর্তী ব্যান্ডদল নিয়াভ নি কারাকে বাদ্যের তালে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তবেই মঞ্চ ছাড়লো জলের গান।
নিয়াভ নি কারা আয়ারল্যান্ডের ফোক শিল্পী। তাকে ইশ্বরপ্রদত্ত সুরশিল্পীই ডাকা হয়। ২০১৪ সালে ফিমেল মিউজিশিয়ান অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন। আর গানে হাতেখড়ি চার বছর বয়স থেকে। একাই গান নিয়াভ নি কারা। সঙ্গে দুজনের একজন গিটার আরেকজন ছোট্ট ড্রাম বাজান। আর নিয়াভ ম্যান্ডোলিন হাতে সুরের ঢেউ তোলেন আর মিষ্টিসুরে গান ধরেন। ব্যর্থ প্রেমিকের গান, লোকলজ্জ্বায় পড়া পুরুষের গান। আর মাঝে মাঝে কনসার্টিনা বাজিয়ে জানান দেন কি দারুণ দক্ষতা তার হাতে।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আর বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরকে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি করে মঞ্চে মূল আয়োজক সান ফেস্ট’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর উপস্থিতি ও আনুষ্ঠানিকতাটুকু সেরে নেওয়ার মধ্যেও ছন্দ ছিলো। বক্তব্যে পরিমিতি বোধের কারণেই হয়তো সেটুকু গ্রহণ করে নিয়েছিলেন সঙ্গীত প্রেমি দর্শকরা। আসাদুজ্জামান নূরের মাটির টান, শেকড়ের সন্ধান আর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা ভুলে না যাওয়ার আহ্বানে দর্শকের সাড়া ছিলো দারুণভাবে।
মঞ্চ গানে ফেরে ইন্ডিয়ান ওশেন এর পরিবেশনা দিয়ে। ওদের বলা হয় ভারতের রক-ফোক ব্যান্ড দল। ফোক আর রক দুই ধারার দুই গান। কিন্তু সেই বিপরীতমুখী দুই ধারাকে এক ক্যানভাসে কি দারুণ করে সাজানো যায় তা ইন্ডিয়ান ওশেন ছাড়া আর কেউ ভালো জানবে না। কারণ তাদের এই চেষ্টা প্রায় আড়াই দশকের। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মাঠের ও মানুষের মুখের গান টেনে এনে বাংলাদেশের দর্শকদের মাতালেন রাহুল রাম, হিমাংশু জোশি, অমিত কিলামরা। গিটারে, ঢোলকে, একতারায় তাদের দারুন দখলও দেখালেন। বাজনার তালে দর্শকের তালির এক অসাধারণ পরিবেশনাও ছিলো মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো।
এরপর পার্বতী বাউল। এ কোন বাউল, কেমন বাউল? দেখে মনে হবে ছোট্ট মেয়েটি। কিন্তু তার বোলের আর বেশের বাউলিয়ানায় এরই মধ্যে পূর্ব-পশ্চিম মুগ্ধ। এবার মাতালেন বাংলাদেশকে। কানায় কানায় পূর্ণ আর্মি স্টেডিয়াম পার্বতীর পরিবেশনায় মুগ্ধ। রিতা চক্রবর্তীর ধারা বর্ণনায় রাধা-কৃষ্ণের রাসলীলা কাহিনী জানলেন তারা। সঙ্গে পার্বতীর নাচ আর কোমড়ে বাধা তবলার বোল। আজানুবিস্তৃত জটাচুলের বেনিগুলো উড়িয়ে উড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নাচলেন আর গাইলেন। কালো কানাইয়ে রাধার মগ্নতায় যেনো মগ্ন হয়ে থাকলো হাজারো দর্শক।
আলী আলী... বন্দনায় পাকিস্তানের সুফি কুইন আবিদা পারভীনের পরিবেশনা যখন শুরু হলো তখন রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। তখনও দর্শক ঢুকছে স্টেডিয়ামে। যেনো নাইট ইজ স্টিল ইয়াং। আবিদার পরিবেশনায় ছিলো উপমহাদেশের এক অসাধারণ মেলবন্ধন। তার সঙ্গে ঢোল বাজিয়ে তাল ধরেন একজন ভারতীয় আর বাশি বাজান বাংলাদেশি শিল্পী।
এই আয়োজনের এও ছিলো এক শ্রেষ্ঠ দিক। শিল্পের আর সংস্কৃতির মাঝে নেই কোনও সীমারেখা। ঢাকায় এবারের ফোক ফেস্টিভাল সেকথাই প্রমাণ করলো দারুণভাবে।
বাংলাদেশ সময় ১০৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
এমএমকে