২০১৭ সাল থেকে দেশীয় সংগীতাঙ্গনের নতুন-পুরনো সব শিল্পীকে অডিও কিংবা চলচ্চিত্রের নতুন গানের ক্ষেত্রে হাতেগোনা শিল্পী-সুরকার-গীতিকারদের সংগঠন বিএলসিপিএস (বাংলাদেশ লিরিসিস্টস কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফরমার্স সোসাইটি) অথোরিটি হিসেবে অনুমোদন দেবে। ডাক ও টেলিযোযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের এ বক্তব্য নিয়ে তৈরি হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
সরকারিভাবে যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তাতে নতুন গান-বাজনা করার জন্য সম্মানী কিংবা রয়্যালটির বিষয়টি দেখভাল করার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট একটি সংগঠন থাকবে। তাদেরকে গান বুঝিয়ে দিতে ও তাদের কাছ থেকে সম্মানী বুঝে নিতে হবে শিল্পীদেরকে। এটাকে আইনে পরিণত করার জোর চেষ্টা চলছে। এখানেই যতো আপত্তি।
বৃহত্তর সংগীতশিল্পী সমাজের মন্তব্য, গান করার জন্য সংগঠনের অনুমতি নিতে হবে কেনো? তাদের দাবি- মেধার অধিকার স্বত্ত্ব শিল্পীর নিজের, তাই নিজের গান যে কোনো শিল্পী যাকে খুশি তাকে দিতে পারে।
সংগঠনটির সদস্য নন এমন শত শত শিল্পী এ বিষয়ে একমত কি-না তা না ভেবেই কেনো এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএলসিপিএস-এর এই উদ্যোগ ও পরিকল্পনার সঙ্গে দেশের বেশিরভাগ শিল্পীই একমত নন। সংগঠনটি কারও অনুমতি না নিয়েই ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পেশ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির কয়েকজন নেতাকর্মীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে কথাও বলেছেন সদস্য নন এমন কয়েকজন শিল্পী।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অথোরিটি পেলে তা সব শিল্পীকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে বিএলসিপিএস, এমন খবরও আছে। কিন্তু সংগীতশিল্পীদের বড় একটি অংশের সাফ কথা, তারা এটা কোনোভাবেই গ্রহণ করবেন না। তাদের প্রশ্ন- বিএলসিপিএস’কে সব শিল্পীর পক্ষে মন্ত্রণালয় থেকে অথোরিটি নেওয়ার দায়িত্ব কে দিয়েছে? একথা ভেবে সবাই বিস্মিত!
গত ২৬ জানুয়ারি সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের প্রতিনিধি এবং সংগীতশিল্পী, সুরকার ও গীতিকারদের সঙ্গে বৈঠকে ডাক ও টেলিযোযোগ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজস্ব দিতে শিল্পীদের সরাসরি অনুমতি নিয়ে মোবাইল ফোনে ওয়েলকাম টিউন (গান) ব্যবহার করতে হবে। তবে বেশিরভাগ সংগীতশিল্পীর মন্তব্য এতে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে।
বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তি করে মোবাইলে ওয়েলকাম টিউন ডাউনলোডে চার্জ নিচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন শিল্পী-সুরকার-গীতিকাররা। নতুন করে চুক্তি নবায়ন করার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে নতুন গানের ক্ষেত্রে বিএলসিপিএস হবে অথোরাইজড প্ল্যাটফর্ম। এ বিষয়ে আগামী সাতদিনের মধ্যে বিএলসিপিএস’কে চিঠি দেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ’
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, অনেক শিল্পীর পক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে একজন স্বনামধন্য গীতিকার ফোন করে এ বিষয়ে আপত্তি জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএলসিপিএস’কে অথোরাইজড প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চিঠি দেওয়ার প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে তাকে নিশ্চিত করেছেন সংস্কৃতি মন্ত্রী। শিল্পীদের তরফ থেকে একটি প্রতিনিধি দলকে যুগ্ম সচিবের সঙ্গে বসে পুরো বিষয়টি সুরাহা করারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ডাক ও টেলিযোযোগ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘রাজস্ব দিতে শিল্পীদের সরাসরি অনুমতি নিয়ে মোবাইল ফোনে ওয়েলকাম টিউন (গান) ব্যবহার করতে হবে। ’ অনেকের প্রশ্ন- শিল্পী বলতে কি তিনি শুধু কণ্ঠশিল্পী বুঝিয়েছেন? নাকি গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী সবাইকেই তিনি শিল্পী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এ বিষয়টি পরিস্কার নয় বলে মন্তব্য সংগীতশিল্পীদের।
মোবাইল অপারেটরদেরকে বলা হয়েছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে যখন অনুমোদন নিয়ে আসবেন, তখন বিটিআরসিকে নিশ্চিত করতে হবে- বিএলসিপিএসের অনুমোদন, এর কপি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ও কপিরাইটের নিবন্ধন আছে কি-না। এরপর সার্ভিসটি অনুমোদন পাবে। মধ্যস্বত্ত্বভোগীকে বিলুপ্ত করে সে জায়গায় বিএলসিপিএস’কে স্থলাভিষিক্ত করতে হবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
এ বক্তব্যে সংগীতশিল্পীদের বৃহত্তর অংশের আশঙ্কা, তাহলে কি অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বলে কিছু থাকবে না? প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের না হয় নতুন গান তৈরির সামর্থ্য আছে, কিন্তু নবীনরা নতুন নতুন গান করার লগ্নিটা পাবে কোত্থেকে? তাদেরকে কে উঠিয়ে নিয়ে আসবে? এসব প্রশ্ন তুলে তাদের দাবি- নিজের গান যাকে খুশি তাকে দেওয়া শিল্পীদের অধিকার। তাদেরকে কেনো একটি সংগঠনের মুখাপেক্ষী হতে হবে? এ নিয়ে ছড়িয়েছে দ্বিধা।
নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের দাবি, এটা শিল্পীদের অধিকার আদায়ের চেষ্টার নামে অপচেষ্টা। বিএলসিপিএস কেনো মনে করলো তারা সারা বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রতিনিধি তা বোধগম্য নয় নবীন-প্রবীণ সংগীতশিল্পীদের। তাদেরকে চক্র বলেও অভিহিত করছেন অনেকে। সেই সঙ্গে এই পদক্ষেপকে ন্যাক্কারজনক হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
এদিকে শিল্পীদের মধ্যে এই বিভক্তি নিয়ে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। অডিও শিল্পের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে এই ভেদাভেদ আরও বেহাল দশা ডেকে আনতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই অতিসত্বর এ অবস্থার সমাধান জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ক্ষেত্রে তথ্য, সংস্কৃতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়েরও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছেন বৃহত্তর সংগীতশিল্পী সমাজ।
* শিল্পীর অনুমতি ছাড়া ওয়েলকাম টিউন নয়
বাংলাদেশ সময় : ০৯০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৬
জেএইচ