কীর্তিমান চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের ৮৬তম জন্মদিনে ‘সুতরাং তিনি অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী হয়েই রইলেন’ নামের স্মারক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হলো। মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে ‘সুভাষ দত্ত-অনুশীলন’ শীর্ষক চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ কর্মশালারও উদ্বোধন করা হয়।
সুভাষ দত্ত স্মৃতি পরিষদ, সুভাষ দত্তের পরিবার ও ভারমিলিয়ন ক্রিয়েটিভ আর্টস অ্যান্ড মিডিয়া ইনস্টিটিউটের এই আয়োজনে ছিলেন চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন, চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ, সাবেক সচিব প্রাবন্ধিক ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী ও চিকিৎসক ঝর্ণা দত্ত। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সুভাষ দত্তের নাতনী আর্জিতা দত্ত।
অনুপম হায়াৎ তার বক্তব্যে বলেন, ‘দাদার (সুভাষ দত্ত) দেশপ্রেম ছিলো ঈর্ষনীয়। তার ভাষাজ্ঞানও ছিলো অত্যন্ত প্রবল। শুদ্ধ উচ্চারণ তার কাছে প্রধান গুরুত্ব পেত। ’ যোগ করে তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারি মাসে একবার ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের জন্য একটি হল বুকিং পেতে আবেদনপত্র লেখার প্রয়োজন পড়লে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ভাষার জন্য বাঙালি জীবন দিয়েছে সেই ভাষাকে ছোট করে এই ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজিতে আবেদন লিখবেন না। তিনি বাংলায় আবেদনপত্র লিখে সেটা জমা দিয়ে বুকিং পর্যন্ত নিশ্চিত করেছিলেন। ’
আলোচকরা বলেন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজকদের অফিস কক্ষে ‘অনুশীলন’ নামে অভিনয়ের প্রাথমিক ক্লাস শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা অভিনয়ের পাশাপাশি বিএফডিসিতে শুটিং ও ডাবিং দেখার সুযোগ পেতো তখন। চলচ্চিত্রের কারিগরি দিকগুলো জানতে পারতো। সুভাষ দত্তের পাশাপাশি তখন সিরাজুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি, বাদল রহমান ক্লাস নিতেন। পরে অবশ্য বিভিন্ন সমস্যার কারণে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আবার ১৯৯৮ সালে ঢাকার স্বামীবাগে সুভাষ দত্ত আবারও ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। তিনি যতোদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এর কার্যক্রম চলেছে।
এবারের অনুশীলনে শিক্ষার্থীরা চলচ্চিত্র অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের শৈল্পিক ও কারিগরি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর শিক্ষা লাভ করবেন বলে জানানো হয়। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সুভাষ দত্ত অভিনীত ও পরিচালিত চলচ্চিত্রের গান পরিবেশন করে গানের দল মনমৃত্তিকা।
সুভাষ দত্ত ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও শিল্প নির্দেশক। চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশল শিখতে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ভারতের বোম্বেতে গিয়ে যান তিনি। এরপর ছায়াছবির পাবলিসিটি স্টুডিওতে মাত্র ৩০ টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করেন।
১৯৫৩ সালে ভারত থেকে ঢাকায় ফিরে যোগ দেন প্রচার সংস্থা এভারগ্রিন-এ। এরপর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেন চলচ্চিত্রের পোস্টার আঁকার কাজের মাধ্যমে। ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পোস্টার ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে দুষ্ট নায়েব কানুলালের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এটি মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি।
ষাটের দশকের শুরুর দিকে নির্মিত বহুল আলোচিত ‘হারানো দিন’ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন সুভাষ দত্ত। মুস্তাফিজ পরিচালিত এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ১৯৬১ সালের ৪ আগস্ট। এটি বাংলা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে এক প্রেক্ষাগৃহে ২৫ সপ্তাহ প্রদর্শনের রেকর্ড তৈরি করে। এরপর বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সুভাষ দত্ত। চলচ্চিত্রে তিনি কৌতুকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেও প্রশংসা অর্জন করেন।
১৯৫৭ সালে ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয় ওয়ারীতে। সেখানে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখেই চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রাণিত হন তিনি। ১৯৬৩ সালের মে মাসে তিনি নির্মাণ শুরু করেন ‘সুতরাং’, এটি মুক্তি পায় পরের বছর। এ ছবির মাধ্যমেই তার হাতধরে উঠে আসেন বরেণ্য অভিনেত্রী কবরী। এটি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা লাভ করেছিল।
১৯৬৮ সালে জহুরুল হক ও প্রশান্ত নিয়োগির লেখা কাহিনি নিয়ে ‘আবির্ভাব’ পরিচালনা করেন সুভাষ দত্ত, এর একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একবার আটক করে সুভাষ দত্তকে। তবে কয়েকটি উর্দু ছবিতেও অভিনয়ের সুবাদে তখন পাকিস্তানেও তিনি পরিচিত মুখ। তাই পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ছেড়ে দেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, যাকে তার বানানো অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭৭ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস ‘২৩ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে তার বানানো ‘বসুন্ধরা’ আজও চলচ্চিত্র সমালোচকদের আলোচনার বিষয়। সত্তর দশকের শেষের দিকে ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি’ অবলম্বনে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করছিলেন ‘ডুমুরের ফুল’ ছবিটি।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৬
জেএইচ