কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কৌশলী’ একটি ছবি ও ক্যাপশনকে ঘিরে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী গীতিকার ও সংগীতশিল্পী শফিক তুহিন। বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) দিনভর অন্তর্জাল দুনিয়ায় রীতিমত ভাইরাল এই ছবি।
প্রকাশিত ছবিটিতে শফিক তুহিনকে উল্লসিত অবস্থায় দেখা গেছে পাকিস্তানের পতাকার পাশে! বিতর্কের কারণ এটাই। এ ছবিকে ‘ইস্যু’ করে তাকে গালমন্দ করা আর দেশত্যাগের পরামর্শও দিয়েছেন কেউ কেউ। কলকাতায় বাংলাদেশের খেলা দেখতে যাওয়া এই শিল্পী বিষয়টি নিয়ে তখনও মুখ খোলেননি। অবশ্য কাছের মানুষরা বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করে জেনেছিলেন তার মানসিক দুরাবস্থার খবর। তিনি তখন বিমর্ষ ও বিপন্ন। এ অবস্থায় সবাইকে ধৈর্য্য ধরার কথা বলেছিলেন তিনি।
শুক্রবার (১৮ মার্চ) ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন শফিক তুহিন। তার স্ট্যাটাসের শুরু- ‘সবাই কম বেশি জানেন আমি একজন ক্রিকেট পাগল। ঢাকায় খেলা হয়েছে, বাংলাদেশ খেলছে আর শফিক তুহিন নেই, এই দৃশ্য বিরল। কিন্তু কলকাতা, এই তো পা বাড়ালেই পা পড়ে রয় দূরত্বের কলকাতা, আরাধ্যতম মাঠ ইডেন। বাংলাদেশ যেখানে একটা মাত্র ম্যাচ খেলেছিলো, তা-ও আজ থেকে ২৫ বছর আগে! সেখানে আবার লাল-সবুজ নাচবে, গ্যালারি প্রকম্পিত হবে বাংলাদেশ বাংলাদেশ স্লোগানে, আর বিরোধী শিবিরে থাকবে পাকিস্তান! রচিত হবে আরেকটি গল্প। ইডেনেই। অথচ আমি থাকবো না! আমার গায়ে লাল সবুজের জার্সি। সেই জার্সির বুকে বড় বড় হরফে লেখা বাংলাদেশ! এই বাংলাদেশ বুকে নিয়ে সেদিন আমি, সঙ্গে গায়ক মাহমুদ জুয়েল, টাইগার মিলন, বাংলাদেশ ক্রিকেট সাপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সব সমর্থক, শুন্য ব্যান্ডের এমিলসহ চেনা অচেনা অনেক মানুষ ইডেনের গ্যালারিতে। ’
স্ট্যাটাসে তুহিন আরও উল্লেখ করেন, ‘…সেই আমি, পরদিন ফেসবুকে তাকিয়ে দেখি…আমি পাকিস্তানি পতাকার পেছনে, পাকিস্তানি সমর্থকদের সঙ্গে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে দাঁড়িয়ে আছি, উল্লাস করছি! দেখে দীর্ঘ সময় স্তব্ধ ছিলাম। একটি স্থিরচিত্রের একটি বিচ্ছিন্ন ছবির, বিচ্ছিন্ন দৃশ্যের অজস্র অর্থ এবং ব্যখ্যা দাঁড়াতে পারে! কিন্তু তার একটাও প্রকৃত ঘটনা না-ও হতে পারে! কিন্তু এই যুক্তিতে গেলাম না। ’
শফিক তুহিন ভাইরাল হওয়া ছবিটির ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, ‘…আসল সত্যটি হলো ইন্টারন্যাশনাল গ্যালারিতে সাধারণত সব দেশের মানুষ থাকে। সেদিন খেলা শুরুর আগে অসংখ্য ফটো সাংবাদিক দুই দেশের সমর্থকদের ছবি তোলা শুরু করলো। এই স্ট্যাটাসে যুক্ত নন এডিটেড ছবিটা দেখলেই বুঝবেন যার যার দেশের জন্য এক ধরনের উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ। এডিটেড ছবি প্রকাশের পর শুরু হলো দেশ থেকে অজস্র মানুষের ফোন, মেসেজ। ফেসবুকে ছবিটি রীতিমত ভাইরাল হয়ে গেলো! আমি থ’ মেরে বসে রইলাম, কী জবাব দেবো এদের আমি? যদি আমি না হয়ে ঠিক একইভাবে পাকিস্তানের পতাকার সঙ্গে আমার দেশের অন্য কারও ছবি এভাবে দেখতাম, আমি নিজেও প্রবল ঘৃণায় আক্রোশে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতাম। …’
ক্ষুব্ধ শফিক তুহিন আরও লিখেছেন, ‘…বাংলাদেশকে ভালোবাসি, এই অনুভূতি একান্ত নিজের, এই অনুভূতি কারও কাছ থেকে অনুমোদিত করে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। এই অনুভূতি একান্ত আমার, একান্ত নিজের। এই অনুভূতি কাকে বোঝাবো? কীভাবে বোঝাবো? কেন বোঝাব? এই অনুভূতি আমার, একান্ত আমার, আচ্ছা, ভাষার সাধ্য কী সকল অনুভূতি বোঝায়? তারপরও কেবল বুকের ভেতর কষ্ট হয়, কান্না হয়, যখন এই মাটি, এই জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা শরীর, জেগে ওঠা হৃদয়ে, এই মাটির প্রতি কতোটুকু ভালোবাসা, কতোটুকু মমতা, কতোটুকু প্রার্থনা রয়েছে, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে, তা নিয়ে কেউ সংশয় প্রকাশ করে, তখন কষ্ট হয়। প্রবল ভালোবাসার বিনিময়ে কেউ যখন দ্বিধা আর সংশয় ফিরে পায়, তখন তীব্র কষ্ট হয়, তীব্র কষ্ট। তবে সেই কষ্টরাও জানে, বাংলাদেশ মানেই বুকের ভেতর ছলকে ওঠা রক্ত, সেই রক্তের কণা জুড়ে স্পন্দন, ভালোবাসি বাংলাদেশ! ভালোবাসি!’
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৬
এসও