কান (ফ্রান্স) থেকে: সমুদ্রতীরবর্তী শহর কানে এসে প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়তাম প্যালে ডি ফেস্টিভ্যালের উদ্দেশ্যে। এই ভবনই ছিলো কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূলকেন্দ্র।
হোটেল থেকে লাগেজ নিয়ে বেরোতেই গায়ে কাঁপুনি ধরে গেলো। ট্যাক্সিতে চড়ে প্যালে ডি ফেস্টিভ্যালের সামনে হাজির হতেই মনে হলো- গত ১২ দিনের হৈচৈ, কোলাহল আর উন্মাদনা যেনো রাতারাতি মিলিয়ে গেলো সেই হাওয়ায়! এ যেনো চলচ্চিত্রের মিলনমেলা সাঙ্গ হওয়ার বিরহী হাওয়া।
ভূমধ্যসাগরের ঘন নীল উপকূলে আঁচড়ে পড়া ঢেউয়ের গর্জন ছাড়া চারপাশের সবই প্রায় নিস্তেজ। গত ১১ মে থেকে কান চলচ্চিত্র উৎসবকে ঘিরে এই অঞ্চল ছিলো জনারণ্য। ১২ দিন পর ২২ মে আয়োজনটির পর্দা নামতেই জায়গাটির পরিবেশ কেমন যেনো ভূতুড়ে মনে হচ্ছে! উৎসবটিকে ঘিরেই মূলত শহরটিতে পর্যটক ও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আগমন ঘটে। দক্ষিণ ফ্রান্সের শহরটির বাসিন্দা মোট ৭৪ হাজার। উৎসব চলাকালীন তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখে। ফলে উৎসব শেষ হলে সুনসান নীরবতা তো নেমে আসবেই।
প্যালে ডি ফেস্টিভ্যালের আশপাশ হেঁটে হাতেগোনা কয়েকজনকে চোখে পড়লো। দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে অনেকক্ষণ পরপর দু’-একজন সড়কের ফুটপাতে হেঁটে যাচ্ছেন। লুমিয়েরের সামনে লালগালিচা ঠিকই রয়েছে। এর ওপর দিয়েই ২২ মে এবারের স্বর্ণপাম জয়ী বর্ষীয়ান ব্রিটিশ নির্মাতা কেন লোচসহ অন্য বিজয়ীরা হেঁটেছেন। তাদের ছবি তুলতে আলোকচিত্রীর অভাব ছিলো না। কিন্তু সোমবার তাদের কেউই নেই।
১১ মে থেকে লুমিয়েরের সামনের সড়কের দুই পাশে অপেক্ষমাণ উৎসুক আমজনতার জটলা, তাদেরকে অটোগ্রাফ দিয়ে ও সেলফি তুলে গান-বাজনার মধ্য দিয়ে লালগালিচায় তামাম দুনিয়ার নক্ষত্রদের হেঁটে যাওয়া, তাদের অংশগ্রহণে সংবাদ সম্মেলন, প্রেস রুম ও ওয়াইফাই জোনে বিভিন্ন সাংবাদিকদের আনাগোনা, দিনভর প্রতিযোগিতা, প্রতিযোগিতা বিভাগের বাইরের আনসার্টেন রিগার্ড, সিনেফন্ডেশন, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ধ্রুপদী চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী- এগুলো দেখার জন্য ইনভাইটেশন প্রত্যাশীদের ভিড়, বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়নে নানান ভাষার চলচ্চিত্রের প্রচারণা, বিভিন্ন দেশের ফিল্ম প্রফেশনালদের অংশগ্রহণ, পুরস্কার বিতরণী- সব মিলিয়ে জমজমাট আয়োজন যাকে বলে, কান ছিলো তেমনই। পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিচিত্র বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর পয়লা দর্শন নেওয়া যায় এখানেই।
কান মানেই শিল্প আর জৌলুসের দারুণ সম্মিলন। ১১ দিনব্যাপী হয় বলে এ আয়োজন নিয়ে লিখতে সরাসরি অংশ নেওয়ার ফলে অন্যরকম মায়া তৈরি হয়ে যায়। সমাপনী অনুষ্ঠান ঘনিয়ে আসার সময় থেকে এই শহরকে বিদায় জানাতে হবে ভেবে বিষণ্ন হয়ে ওঠে মন। বৈচিত্র্য আর বহুমাত্রিকতার জন্য প্রসিদ্ধ কান উৎসবকে বলা হয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম বৃহৎ মিলনমেলা। এই মেলা আবার জমবে ২০১৭ সালের মে মাসে।
কফি শেষ করে গাড়িতে উঠে কান ছাড়ার আগে সকালে আকাশে তাকিয়ে দেখলাম বৃষ্টি নামানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে মেঘেরা। টানা দ্বিতীয়বার বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন আয়োজন কান উৎসবে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে চললাম প্যারিসের পথে।
গতবার প্যারিস থেকে কানে এসেছিলাম ট্রেনে। আবার কান থেকে প্যারিস গিয়েছি ট্রেনে চড়েই। এবার উড়োজাহাজে নিস বিমানবন্দরে এসে নেমেছিলাম গত ০৯ মে। এবার ভাবলাম, সড়কপথে যাই। ব্লা ব্লা কারে চড়ে রওনা দিলাম। যেতে যেতে কানে বিখ্যাত তারকা, নির্মাতা ও উৎসব পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমোর সঙ্গে সেলফি তোলা, তাদের অটোগ্রাফ নেওয়া, সংবাদ সম্মেলনগুলোতে অংশ নেওয়া, মেয়রের নিমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজ, উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের লালগালিচায় হাঁটার স্মৃতিগুলো মনে করে সময় কাটলো।
বাংলাদেশ সময়: ০৩১১ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৬
জেএইচ/এসএনএস