ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

‘শারমীন তুমি কার মা? তুমি আমার মা’

তৃণা শর্মা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২২ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৬
‘শারমীন তুমি কার মা? তুমি আমার মা’ শারমীন আক্তার, ছবি: প্রণব অন্তু-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

‘আড়ং ডেইরি-চ্যানেল আই বাংলার গান’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন শারমীন আক্তার। শত বাধা আর প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও লোকসংগীত চর্চা ধরে রেখে তিনি আজ সবার সেরা! তাকে নিয়ে তারার ফুলের এই প্রতিবেদন... 

‘তুমি কার মা? তুমি আমার মা’- এলআরবি ব্যান্ডের আইয়ুব বাচ্চু।

‘আমি জানি না আবার মানুষ হিসেবে জন্মাবো কি-না। যদি মানুষ হিসেবে জন্মাই তাহলে যেন তোর গর্ভে জন্ম হয়’- জলের গান ব্যান্ডের রাহুল আনন্দ। শারমীনের গান শুনে শিল্পীদের কণ্ঠে এমন প্রশংসার ফুলঝুড়ি দর্শক-শ্রোতারা দেখেছে ‘বাংলার গান’ অনুষ্ঠানে।  

আরেকটি পর্বে তো শারমীনকে জড়িয়ে ধরেন ফোকসম্রাজ্ঞী মমতাজ। সেই অনুভুতি কেমন ছিলো? মুকুট জয়ের পরদিন বাংলানিউজের সামনে সেটা জানাতে গিয়ে তার চোখের কোণ ভরে গেলো জলে।  

শারমীন বললেন, ‘অনুষ্ঠানের বিশেষ পর্ব ছাড়া অন্যান্য পর্বে আমরা প্রতিযোগীরা গান নির্বাচনের সুযোগ পেতাম। তবে মমতাজ ম্যামের বিশেষ পর্বে অনেক অনুরোধ করে নিজে গান বাছাইয়ের অনুমতি পেলাম। যদিও গানটি নির্বাচন করে দেন আমার বাবা। গাওয়ার আগে জানতাম না মমতাজ ম্যামের এটি এতো পছন্দের। গান শেষ না হতেই তিনি মঞ্চে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। তখন কিছু বুঝতে না পেরে খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলাম। ’

‘বাংলার গান’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পাওয়া প্রশংসার মধ্যে এগুলো শারমীনের মনে নিশ্চিতভাবেই সবসময় রয়ে যাবে। দুই প্রধান বিচারক রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও সংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু অথবা মেন্টররা তাকে প্রতিনিয়তই বলতেন, সব প্রশংসাসূচক বাক্যই মনে রাখার মতো। শারমীন ছিলেন রাহুল আনন্দের গ্রুপে। ৩৭টি পর্বের মধ্যে প্রায় প্রতি পর্বেই সেরা নম্বর ও সেরা প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। বিচারক ও মেন্টরদের প্রশংসার সঙ্গে দর্শকদের ভোট বেশি পাওয়ায় সেরার মুকুট উঠেছে তার মাথায়।  

২০১৫ সালে মাঝামাঝি শারমীন তার এক আত্মীয়ের চাচার কাছ থেকে জানতে পারেন ‘আড়ং ডেইরি-চ্যানেল আই বাংলার গান’ নামে লোকসংগীতের প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে। এতে নাম নিবন্ধনের মাধ্যমে গানকে সঙ্গী করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু হয় তার।

প্রায় ছয় মাসের পরিশ্রম আর মেধার প্রতিফলন ঘটানোর মাধ্যমে স্বপ্নপূরণ হয়েছে শারমীনের। ছয় মাস বাড়ির বাইরে বাবা, মা, ভাইকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়নি? তার উত্তর, ‘কখনও মা-বাবাকে ছেড়ে থাকিনি। ক্যাম্পে আসার পর শুধু একটাই চিন্তা ছিলো, মানুষকে যেহেতু একবার গান শোনানোর সুযোগ পেয়েছি সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। আরেকটি বিষয় ভেবেছি, গান গেয়ে আমার মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাতে হবে। আমি পেরেছি। ভালোও লাগছে, আনন্দ হচ্ছে। গত ছয় মাস চ্যানেল আইয়ে অন্যান্য প্রতিযোগীর সঙ্গে থেকেছি, এখন তাদেরকে ছেড়ে যেতেও কষ্ট হচ্ছে। ’

শারমীনের পৈতৃক বাড়ি ময়মনসিংহ হলেও তার জন্ম ঢাকায়। ছোটবেলা থেকেই গান শেখা শুরু। দাদা ছিলেন। লোকসংগীত শিল্পী সেই সুবাদে বাবাও লোকগান গাইতেন। গানে শারমীনের হাতেখড়ি বাবার কাছেই।

বাড্ডা আলাতুনেসা ঊচ্চ বিদ্যালয়ে মানবিক শাখার নবম শ্রেণীর ছাত্রী শারমীন। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা তার। গান গেয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ায় তার বাবা গাড়ি চালানো শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় আবারও সংসারে অসচ্ছ্বলতা ফিরে আসে। এর মধ্যে পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও সংগীত চর্চা থামিয়ে রাখেননি শারমীন। বিফলে যায়নি তার প্রয়াস। ‘বাংলার গান’ বদলে দিলো তার জীবন। মাটির গান, দেশের গান শুনিয়ে হৃদয় জিতেছেন এই কিশোরী।  

একসময় অর্থাভাবে যার পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, এখন সেই শারমীনের সামনে অনেক দুয়ার। তার পড়াশোনার সব দায়িত্ব নিয়েছে ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এদিকে আলাতুনেসা ঊচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাদের বাসায় গিয়ে শারমীনের মা-বাবাকে অনুরোধ করেছেন এখানেই পড়াশোনা করতে। সব খরচ বহন করবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।  

এসব সুখবরে শারমীন বললেন, ‘সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। আমি আসলে গানের পাশাপাশি সবসময় ভালোভাবে পড়াশোনা করতে চেয়েছি। এ প্রতিযোগিতায় অংশ না নিলে বুঝতাম না আমার জীবনে এতো প্রাপ্তি অপেক্ষা করছে। ’

বিনা খরচে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ার আগে মুকুটের সঙ্গে শারমীন পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ১০ লাখ টাকা। এতো টাকা কী করবেন? তার উত্তর, ‘আমার বাবা বাউল গান শেখাতেন আগে। সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে এখন আর গান শেখাতে পারেন না। তাই আমার ইচ্ছা আছে সেই টাকা দিয়ে বাবাকে একটি গানের স্কুল গড়ে দেবো। তবে এই স্কুলে টাকার বিনিময়ে গান শেখানো হবে না। আমার এই পর্যন্ত আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। আমি চাই না আর কেউ এমন কষ্ট করুক। ’

দেশে এর আগে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে কয়েকজন লোকসংগীত শিল্পী প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাদের গান শোনেন শারমীন। খুব উৎসাহ নিয়ে তিনি বললেন, ‘ক্লাস ফোরে পড়ার সময় থেকে সালমা আপুর ‘বানিয়া বন্ধু’  গানটা শুনে শুনে শিখেছিলাম। তার গাওয়া সব গান নিয়মিত শুনি। এ ছাড়া বিউটি আপু আর রিংকু ভাইয়ের পরিবেশনাও আমার খুব ভালো লাগে। ’

সালমা, বিউটি কিংবা রিংকুর মতো যারা লোকসংগীত চর্চা করছেন, শারমীন যুক্ত হলেন সেই দলে। গান নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকদূর যেতে চাই। আমার দেশের মাটির গান বিশ্বের সবাই শুনলে গর্ব হয়। পৃথিবীকে জানাতে চাই আমার দেশের গানে কতো না মায়া!’

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩১ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৬
টিএস/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।