চার্লি চ্যাপলিনের পর তিনিই পৃথিবীর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাকে দেশটির বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাকে প্রদান করে দেশটির সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন। সেই বছরেই মৃত্যুর পরে সত্যজিৎকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সাইন্সেস তাকে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ অস্কার প্রদান করে। ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্টা ক্রুজ সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড স্টাডি কালেকশন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৫ সালে ভারত সরকার চলচ্চিত্র বিষয়ে গবেষণার জন্য সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটও প্রতিষ্ঠা করে।
তবে সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিয়ারে পাওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো ১৯৯২ সালে অ্যাকাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কারটি (অস্কার), যা তিনি সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেন। যদিও অসুস্থ থাকায় তিনি পুরস্কার মঞ্চে উপস্থিত থাকতে পারেননি। মৃত্যুশয্যায় তার অস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতির ভিডিও ধারণ করে পরবর্তীকালে অস্কার অনুষ্ঠানে দেখানো হয়, যেটি ঘোষণা করেছিলেন অড্রে হেপবার্ন।
শুধু ভারতবর্ষে নয়, সত্যজিৎ রায়ের গণ্ডি ছিল বিশ্বের কোনায় কোনায়। ১৯৬২ সালে সত্যজিৎ’র লেখা ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ নামক একটি বাংলা কল্পগল্প সন্দেশ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। গল্পের কাহিনি আবর্তিত হয় একটি মহাকাশযান নিয়ে, যা গ্রামবাংলার কোন এক পুকুরে অবতরণ করে এবং গ্রামবাসীরা এটাকে মন্দির ভেবে এর পূজা শুরু করে দেয়।
সেই গল্পের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৭ সালে সত্যজিৎ রায় ‘দ্য অ্যালিয়েন’ নামের একটি চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখেন, যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। চলচ্চিত্রটির প্রযোজক হিসেবে ছিল কলাম্বিয়া পিকচার্স আর পিটার সেলার্স এবং এর প্রধান অভিনেতা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল তৎকালীন হলিউডের সুপারস্টার মার্লোন ব্রান্ডোকে।
কিন্তু চিত্রনাট্য লেখার কাজ শেষ করে সত্যজিৎ জানতে পারেন যে সেটির স্বত্ব তার নয় এবং এর জন্য তিনি কোন সম্মানীও পাবেন না। মার্লোন ব্র্যান্ডো সে সময়ে প্রকল্পটি থেকে বেরিয়ে আসেন। মার্লোনের স্থানে জেমস কোবার্ন-কে আনার চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু সত্যজিৎ নিরাশাভরে কলকাতায় ফিরে যান। এরপর ৭০ ও ৮০-র দশকে কলাম্বিয়া কয়েকবার প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
১৯৮২ সালে যখন স্টিভেন স্পিলবার্গের ই.টি. দি এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল মুক্তি পায় সেটির কাহিনির সঙ্গে অনেকেই তখন সত্যজিৎ রায়ের লেখা চিত্রনাট্যের মিল খুঁজে পান। সত্যজিৎ ১৯৮০ সালে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের একটি ফিচারে প্রকল্পটির ব্যর্থতা নিয়ে বলেছিলেন। ঘটনার আরও বৃত্তান্ত রয়েছে অ্যান্ড্রু রবিনসনের লেখা সত্যজিৎ রায়ের জীবনী ‘দি ইনার আই’-এ। সত্যজিৎ’র মতে তার লেখা ‘দ্য এলিয়েন’র চিত্রনাট্যটির মাইমোগ্রাফ কপিটি সারা যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে ছড়িয়ে না পড়লে হয়তো স্পিলবার্গের পক্ষে চলচ্চিত্রটি বানানো সম্ভব হতো না।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মোট ১৪টি সিনেমায় কাজ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাদের এই জুটি বিশ্বের চলচ্চিত্র বিশ্লেষকদের কাছে মিফুন ও কুরোশাওয়া, মাস্ত্রোইনি ও ফেলিনি, ডি নিরো ও স্করসিসের জুটির মতোই বিখ্যাত।
প্রথম রঙিন বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৬২ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘা চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেন ছবি বিশ্বাস, অনিল চট্টোপাধ্যায়, করুণা চট্টোপাধ্যায়, অনুভা গুপ্ত প্রমুখ। চলচ্চিত্রে আসার আগে একজন প্রথিতযশা গ্রাফিক ডিজাইনার ছিলেন সত্যজিৎ। যিনি বহু বিখ্যাত বইয়ের কভার পাতা ডিজাইন করেছেন। এরমধ্যে অন্যতম হলো জিম করবেটের ‘ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন’, জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আম আটির ভেঁপু’।
১৯৮৩ সালে ঘরে বাইরের কাজ করার সময় হার্ট অ্যাটাকের পরে কাজের গতি কমিয়ে দেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৯২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সত্যজিৎ রায় ভর্তি হন হাসপাতালে। অস্কার পুরস্কার প্রাপ্তির মাত্র তেইশ দিন পর ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়, সবার প্রিয় মানিক দা (সত্যজিৎ রায়ের ডাকনাম) পার্থিব জীবন থেকে চিরবিদায় নেন।
তার মৃত্যুর পর কলকাতার জীবনযাত্রা থেমে পড়ে। হাজার হাজার লোক শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার বাড়িতে যায়। মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি যেন আগের মতোই জীবন্ত, সকল চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের মনে...আজও।
***লেখক, স্বাধীন চলচ্চিত্রকার ও সমাজকর্মী
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২০
জেআইএম/