এই করোনাকালে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবচেয়ে দুশ্চিন্তার জায়গা হলো থিয়েটার। কারণ থিয়েটার পুরোপুরিভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগে গড়ে ওঠে।
কিন্তু করোনাকালে মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলার নিয়ম। তাহলে থিয়েটার কি হবে না? অনেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এই ‘স্বাভাবিক হওয়া’ কথাটার মধ্যে পুরনোকে খোঁজার ব্যাপার রয়েছে।
কিন্তু পুরনো পৃথিবীকে পাওয়া যাবে না আর কখনোই। পুরনো পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশই বদলে যাবে। মহাকাল কেবল সামনের দিকেই এগিয়ে যায়। এগিয়ে গিয়ে সে পৃথিবীর মানুষকে কিছু সীমাবদ্ধতা দেয়, কিছু চ্যালেঞ্জ দেয়। সেগুলো সঙ্গে নিয়ে মানুষ আবার নিজের চারপাশটা সহনীয় করতে শুরু করে, গড়তে শুরু করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেই দিয়েছে করোনাকে নিয়েই চলতে হবে। সুতরাং মানুষকে এই চ্যালেঞ্জটাও গ্রহণ করতে হবে। তার মানে করোনাকে সঙ্গে নিয়ে থিয়েটারটাও করতে হবে। কীভাবে সেটা সম্ভব, তাই এখন ভাবনার বিষয়।
থিয়েটারকর্মীদের জন্য এটা অনেক বড় মোকাবিলার বিষয়। থিয়েটার অনুষ্ঠিত হয় মূলত দু’টি জায়গার সমন্বয়ে। এক. যেখানে অভিনেতারা অভিনয় করেন, দুই. যেখানে দর্শক বসে নাটক দেখেন। করোনাকালে মানুষের থেকে মানুষ অন্তত তিন ফুট দূরে থাকতে হবে। তিন ফুট দূরে দূরে থেকে মহড়া করা, তিন ফুট দূরে দূরে থেকে নাটক মঞ্চস্থ করা। আবার দর্শকও থাকবেন ততটা দূরে। আবার এক দর্শক থেকে অন্য দর্শক থাকবেন সে রকম তিন ফুট দূরে দূরেই।
শুধু এই দূরত্বের বিষয় হলেও হতো, কিন্তু কোনো জায়গাই এখন করোনা-সন্দেহের বাইরে নয়। তাই থিয়েটারের জায়গাটা সন্দেহমুক্ত করতে হবে।
বিষয়টা বলা যতটা সহজ বাস্তবায়ন করা ততটা সহজ নয়। আরো সহজ নয় মহড়া করা, নতুন নাট্যকর্মী নেওয়া, নতুন নাটক নির্মাণ করা এবং সর্বোপরি দর্শককে মিলনায়তনে আনা। তাই বলা যায় থিয়েটার অঙ্গন নতুন কোনো পরিবর্তনের অপেক্ষায় রয়েছে। ইংরেজরা ভারতবর্ষে আসার পর এই উপমহাদেশের যেমন আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল, সেই রকম কোনো পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে থিয়েটার।
কাহিনিগত এবং আঙ্গিগত দিক দিয়ে নাটকের একটি বড় বাঁক বা পরিবর্তন তো ঘটবেই, ‘থিয়েটার কনসেপ্ট’-এরও পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
থিয়েটারের বিভিন্ন দিকের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাটকের বিষয় বা কাহিনিগত পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে, পরিবর্তনটা বেশ বড়সড়ো পরিবর্তন হবে। কাহিনি মানে তো মানুষের জীবন, স্বভাব-চরিত্র, সমাজ, সামাজিক বোধ। মানব জাতির স্বভাবগত এবং চরিত্রগত পরিবর্তন যদি হয়ে যায়, তাহলে কাহিনিতে পরিবর্তন হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যদি করোনাকে নিয়েই চলতে হয়, তাহলে মানুষের বাহ্যিক দিকের বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সব মানুষ পরিবারের বাইরে বা ঘরের বাইরে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে আছেন। একজন আরেকজনকে সরাসরি দেখার ব্যাপারটা থাকছে না। মানুষের বয়স, মানুষের ব্যক্তিত্ব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলছে।
এই যে মানুষের মানসিক পরিবর্তন তা নাটকের কাহিনিতে অবশ্যই আসবে। তাছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রভাব ফেলছে মানুষের মনে এবং জীবনযাত্রায়। বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ঘটা শুরু হয়ে গেছে, এটা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সঙ্গত কারণে বেকার সমস্যাও বাড়বে।
মৃত্যুভয় মানুষকে তাড়া করতে থাকবে বলে কিছু মানুষের খুব ভীত হওয়ার সম্ভাবনা, আবার কিছু মানুষের অতি বেপরোয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
পরিবর্তিত হয়ে যাবে সম্পর্কের সংজ্ঞা, প্রেমের সংজ্ঞা, মাতৃত্ব-পিতৃত্বের সংজ্ঞা, আত্মীয়তার সংজ্ঞা, বন্ধুত্বের সংজ্ঞা, সামাজিকতার সংজ্ঞা, মানুষের আচার-আচরণের সংজ্ঞা, পারিবারিক-সামাজিক অনুষ্ঠানের সংজ্ঞা সর্বোপরি জীবনযাত্রার সংজ্ঞা। মানুষের সঙ্গে মেলামেশার পরিধি এবং পরিসর পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। কাহিনিতে আরও দেখা যাবে জীবনের অংশ এবং পরিমিতি বোধ। অতীতে ৫০ থেকে ৫৫ জন অভিনেতাকে নিয়ে নাটক করা সম্ভব ছিল, করোনাকে সঙ্গে নিয়ে তা আর সম্ভব নয়। তাই কাহিনিতে এই বিষয়টিও আসবে বলে মনে করছি।
নাট্যকার ঘরে বসে কাহিনি লিখে ফেললেন। কিন্তু মঞ্চস্থ করা? চিন্তা করছি ভার্চুয়ালি কি থিয়েটার করা সম্ভব? কারণ শারীরিকভাবে মানুষ যতটা দূরে চলে গেছেন, ঠিক ততটাই ভার্চুয়ালি কাছে এসেছেন। আমার ধারণা ইন্টারনেট মানব জীবনের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ দখল করে নেবে। তাহলে জুমে কিংবা স্টিম ইয়ার্ডে কি থিয়েটার সম্ভব? না, সেটা বড়জোর পাঠাভিনয় হতে পারে। নাটমন্দির, প্রসেনিয়াম, স্টুডিও থিয়েটার কিংবা কোনো একটি ঘরেও যদি কোনো কাহিনির অভিনয় হয়, সেটা জীবন্ত মানুষকেই অভিনয় করতে হবে। তবেই সেটা থিয়েটার।
রেকর্ড করা বা ভিডিও করা হলে তা আর থিয়েটার থাকবে না। হ্যাঁ তার সঙ্গে ভিজ্যুয়ালি অনেক উপাদান যোগ হতে পারে, কিন্তু জীবন্ত মানুষ একজন লাগবে। আবার যিনি অভিনয় করছেন তিনিই তো শুধু নন। লাইট, মিউজিক, কস্টিউম, প্রপস, হল-ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদিতে কত লোকের দরকার।
সর্বোপরি রয়েছেন নির্দেশক। তাহলে কতটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে নাটক মঞ্চায়ন সম্ভব? পুরনো নাটকই মঞ্চস্থ করা যাচ্ছে না, সেখানে নতুন একটি প্রযোজনা আনাও কি সম্ভব? অন্তত যখন সবাই ঘরের বাইরে যেতেই ভয় পাচ্ছেন।
নাটক মঞ্চস্থ করা এখন সত্যিই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। উল্লেখ করেছি নিরাপদ মঞ্চের।
কীভাবে মঞ্চটি নিরাপদ করা যায়? একটি নাটকের প্রদর্শনী হওয়ার পর চোদ্দ দিন ফেলে রেখে দেখতে হবে যে নাটকের কলাকুশলীরা কেউ করোনায় আক্রান্ত হলেন কি-না? তারপর আরেকটি দল এসে মঞ্চস্থ করবে নাটক। হায়! এটা সম্ভব নয়। আবার রয়েছে অডিয়েন্স। দেখতে পাচ্ছি একটি অডিয়েন্স। যেখানে চারদিকে এক-দেড় হাত দূরে দূরে এককভাবে একটি করে দর্শকের আসন রয়েছে। সুন্দর পরিচ্ছন্ন, কোনো মানুষের গায়ের ওপর দিয়ে ধাক্কা দিয়ে যেতে হচ্ছে না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রয়েছে। তবে শুধু একক আসন দিলেই দর্শক আসবেন না। সেখানে করোনা ভাইরাস নেই এর নিশ্চয়তা তাকে দিতে হবে। ভাইরাসমুক্ত বা জীবাণুমুক্ত করার জন্য সার্বক্ষণিক মানুষ লাগবে।
মিলনায়তন আঙ্গিনায় ঢোকার মুখে জ্বরমাপক যন্ত্র এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার অবশ্যই থাকতে হবে। তবুও মানুষের সন্দেহ যাবে না। তাই এমন একটি নাটক নির্মাণ করতে হবে, যেন আতঙ্ক এবং ভয়ের মধ্যেও দর্শক আসে। সে ক্ষেত্রে কাহিনি এবং আঙ্গিকে সত্যি সত্যি আমূল পরিবর্তন দরকার। কারণ ভার্চুয়াল মিডিয়ায় এতো চমক থাকে যে, মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থিয়েটার দেখতে আসবেন না। তাদের টেনে আনতে হবে। নাটকে তো নাট্যকর্মীরাই অর্ধেক দর্শক থাকেন। করোনা কালে তারাও থিয়েটার দেখবেন বলে মনে হয় না। বেশিরভাগ নাট্যকর্মী শুধু নিজের নাটক করে বাড়ি এসে বসে থাকবেন। তাই মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে বাঁক পরিবর্তন আসছে বলেই মনে হয়।
মনের মধ্যে যে সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, সেটা হলো, এই সুযোগে কি পরিবার কেন্দ্রিক থিয়েটার জনপ্রিয় হবে? কারণ পরিবারের মানুষগুলো একসঙ্গে থাকতে পারছে। তাই তারা মহড়া করতে পারবে নির্ভয়ে। তারপর কোনো নিরাপদ মঞ্চে গিয়ে অভিনয় করে আসা। কিংবা নিজের বাড়িতে কোনোভাবে থিয়েটার স্টুডিও বানিয়ে নাটক করা। এক সময় ঠাকুর বাড়িতে এ রকম থিয়েটার হতো তো। আবার যে নাট্যকর্মী যে এলাকায় থাকেন তারা সে এলাকায় বা ফ্ল্যাট বাড়ি হলে তাদের সুবিধাজনক জায়গায়, সেটা কমিউনিটি সেন্টারের ঘরে বা ছাদে বা গাড়ি বারান্দায় নাটক মঞ্চস্থ হতে পারে।
অথবা যাত্রা পালার লোকেরা যেমন দলবদ্ধভাবে থাকতেন। তাদের থাকা-খাওয়া, ওঠা-বসা এক সঙ্গে হতো, সে রকম যদি থিয়েটারের দলের মানুষগুলো একসঙ্গে কোয়ারেন্টিনে থেকে মহড়া করে নেন! এ রকম অনেক কিছুই মনে আসছে। হয়তো এগুলোর কোনটাই সম্ভব নয়, অথবা ক্ষেত্র বিশেষে সম্ভব। তবে সামগ্রিকভাবে এটা সমাধান নয়। তাহলে এতো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কী করে থিয়েটার হবে! একটা কথা বেশ অনুভব করছি, থিয়েটারকে আর অ্যামেচার রাখা যাবে না।
এবারের পেশাদারিত্বের জায়গাটা নিশ্চিতভাবে হতে হবে। কারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যদি থিয়েটার করেন, তবে জীবনযাপনের নিশ্চয়তাও তিনি থিয়েটার থেকে চাইবেন। এবং রাষ্ট্রের এবার বড় ভূমিকা নেওয়াও জরুরি বলে মনে করছি। অন্য সব পেশার মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে থিয়েটারকে
পেশার মর্যাদা দিলে মানুষ থিয়েটারমুখী হবে।
আশা করি- মানুষ হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই করোনাকে নিয়ে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। তারা শিখে যাবে করোনাকে কীভাবে ঠেকানো যাবে। কোন কোন নিয়ম মেনে চললে করোনাকে ফাঁকি দেওয়া যাবে। আর যদি প্রতিষেধক বা ওষুধ আবিষ্কৃত হয় তবে তো কথাই নেই। তখন কিছুটা সহজ হতে পারে থিয়েটার করা। তবে কাহিনি, আঙ্গিক, দর্শকের বসার স্থান এবং দর্শককে আনা- এই বিষয়গুলোতে অবশ্যই পরিবর্তন ঘটবে।
আমি এই প্রবন্ধে কাহিনিগত পরিবর্তনের দিক সুস্পষ্ট করেছি। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে একক নাটক, কম অভিনেতার নাটকের উল্লেখ করেছি। আর গ্রুপ
বা দলের ক্ষেত্রে পরিবার কেন্দ্রিক দল, দলগতভাবে এক সঙ্গে অবস্থান করে মহড়া করা ইত্যাদির উল্লেখ করেছি। তবে এর কোনোটিই আমার মনপুত হয়নি। শুধু মনের অনুভবের কথা লিখেছি। নিশ্চয়ই কোনো নতুন পথ বের হবে। পথ বের হবে মঞ্চায়ন এবং দর্শক আনার ক্ষেত্রেও। করোনাকে জয় করে থিয়েটার নিজের নতুন পথ বের করে নেবে অবশ্যই।
***লেখক: নাট্যকার, গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৩ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০২০
জেআইএম