কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যুর পর ঘটেছিল এক আলোচিত ঘটনা। চ্যাপলিন পরলোকগমনের পরবর্তী সুইজারল্যান্ডের কর্সিয়ের-সুর-ভেভেতে তাকে সমাধিস্থ করার কিছুদিন পর সমাধি থেকে লাশ গায়েব হয়ে যায়! এই ঘটনা সবাইকে অবাক করেছিল।
ভক্তরা ভেবেছিলেন, হাসির রাজা সবাইকে হাসাতে আবারো সমাধি ছেড়ে উঠে আসেননিতো! তবে না, শেষটায় অতটা নাটকীয়তা হয়নি। জানা যায় শহরের দু’জন বেকার অভিবাসী চ্যাপলিনের সমাধি খুঁড়ে কফিন জব্দ করে চ্যাপলিনের স্ত্রী উনা অনিল চ্যাপলিনের কাছে মুক্তিপণের দাবি করেন। পরে অবশ্য এক পুলিশি তদন্তে ওই অপরাধীরা ধরা পড়ে এবং কফিনটি পুনরায় কর্সিয়ের সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়।
পরনে ঢোলা মলিন প্যান্ট, ছেঁড়াফাটা কোট-টাই, মাথায় কালো ডার্বি হ্যাট, হাতে ছড়ি, পায়ে ছেড়া বুট, ঠোঁট টুথব্রাশ আকারের গোঁফ! কিন্তু মুখে একপ্রস্ত হাসি! টিভি পর্দায় এ চরিত্রকে দেখেনি এমন কাউকে বোধহয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ‘দ্য ট্রাম্প’ চরিত্র দিয়ে দুনিয়া কাঁপানো চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল আজকের এই দিনে লন্ডনের ওয়ালউওর্থে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার জন্মস্থান নিয়ে আছে বিতর্ক। অনেকের ধারনামতে তিনি ফ্রান্সেও জন্মে থাকতে পারেন। আবার, এই ২০১১ সালে উদ্ধারকৃত এক পুরনো দিনের চিঠির মতে, তিনি ভূমিষ্ঠ হন ইংল্যান্ডের স্ট্যাফোর্ডশায়ারের একটি ক্যারাভ্যানে!
চ্যাপলিনের বাবার নাম চার্লস চ্যাপলিন সিনিয়র এবং তার মা হানাহ চ্যাপলিন। তার বাবা-মা দু’জনেই অভিনয় করতেন মঞ্চে আবার পাশাপাশি গাইতেন গানও। চ্যাপলিনের অভিনয়ের দিকে ঝোঁক যে জিনগত তা এই তথ্য থেকে সহজেই অনুমেয়। তবে শৈশব জীবনটা মোটেও সুখে কাটেনি চ্যাপলিনের। ছোট বয়সের পুরোটা সময় জুড়েই ছিল চরম অভাব-অনটন ও নিদারুণ কষ্ট। তার বয়স যখন তিন, তখনই তার বাবা-মা আলাদা থাকতে শুরু করেন, যদিও তাদের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়নি। মায়ের সাথে শিশু চ্যাপলিন থাকতেন, তাদের তৃতীয় সঙ্গী ছিল তার সৎ বড় ভাই সিডনি চ্যাপলিন।
১৮৯৮ সালে সেপ্টেম্বরে তাদের মা হান্নাহকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সিফিলিস ও অপুষ্টিজনিত কারণে। শৈশবে স্কুল জীবনে যখন চ্যাপলিন অনবরত খারাপ ফলাফল করে যাচ্ছিলেন আর ওদিকে তার মা-ও মানসিক অসুস্থতার কাছে হার মানতে শুরু করছিলেন, সেই অবস্থায়ই চ্যাপলিনের অভিনয় জীবনের সূচনা। তবে সেটা মঞ্চে।
চার্লস চ্যাপলিনের বড় পর্দায় অভিষেক হয় এক-রিলওয়ালা সিনেমা ‘মেকিং আ লিভিং’ দিয়ে। এটি মুক্তি পায় ১৯১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। মজার ব্যাপার হলো প্রথম সিনেমা হলেও চ্যাপলিন এটি একদমই পছন্দ করেননি। তবে এতে অভিনয়ের পর কৌতুকাভিনেতা হিসেবে কিছুটা হলেও নামডাক তৈরি হয় তার। তবে দর্শকেরা তার আইকনিক চরিত্র ‘দ্য ট্রাম্পের’ দেখতে পান তার অভিনীত দ্বিতীয় সিনেমায়।
তিনি তার আত্মজীবনীতে লেখেন, আমি আমার পোশাক পরিচ্ছদের সবকিছুতেই অসঙ্গতি চেয়েছিলাম: প্যান্ট, আঁটসাঁট কোট, মাথার বড় টুপি এবং বেঢপ জুতা... আমি একটি ছোট ব্রাশ আঁকারের গোঁফও ব্যবহার করি, যার ফলে আমাকে বয়স্ক দেখাবে কিন্তু আমার অভিব্যক্তিও লুক্কায়িত থাকবে না। আমার এই চরিত্র সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। তবে আমি যখন পোশাকটি পড়ি, সেই পোশাক ও মেকআপ আমাকে সেই ব্যক্তিত্বকে অনুভব করতে সাহায্য করে। আমি তাকে চিনলাম আর যে সময়ে আমি ক্যামেরার সামনে দাড়াই, ততক্ষণে জন্ম নিলো সেই সাড়া জাগানো চরিত্রটি।
নির্বাক যুগের বাকী তারকাদের মতো চ্যাপলিন যে শুধুমাত্র অভিনেতা ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন একজন সফল পরিচালক। তার পরিচালনায় অভিষেক চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯১৪ সালে ৪ মে যার নাম ‘কট ইন দ্য রেইন’। মুক্তির পর ব্যাপক সফলতা লাভ করে সিনেমাটি। এরপরের সময়টিতে তিনি প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটি করে স্বল্পদৈর্ঘ্য আকারে সিনেমা নির্মাণ করেন।
চার্লি প্রথম গাঁটছড়া বাঁধেন ১৯১৮ সালে মিল্ড্রেড হ্যারিস নামক এক মার্কিন অভিনেত্রীর সঙ্গে। যদিও বিয়েটা একরকম ঝামেলায় পড়েই করেছিলেন চ্যাপলিন। ১৬ বছর বয়সী হ্যারিস দাবি করে বসেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা আর তার অনাগত সন্তানের পিতা চার্লি চ্যাপলিন। একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক একজন মেয়েকে নিয়ে আইনী ঝামেলা এড়ানোর জন্যই তিনি তাকে অনেকটা গোপনে বিয়ে করেন। অবশ্য পরে জানা যায়, হ্যারিস মোটেই গর্ভবতী ছিলেন না। চার্লি ও হ্যারিসের সংসার বেশি দিন টেকেনি, ১৯২১ সালেই তারা এই সম্পর্কের পাট চুকান।
চ্যাপলিনের জীবনে বিতর্ক একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাইতো ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ১৯২৪ লিটা গ্রে নামের ১৬ বছরের আরেক কিশোরীকে বিয়ে করেন চ্যাপলিন যার গর্ভে এবারে সত্যি সত্যি চ্যাপলিনের সন্তান ছিল। আগের মতো এ সংসারটিও টেকেনি। চার্লির তৃতীয় স্ত্রীর নাম পলেট গডার্ড যিনি পেশায় একজন অভিনেত্রী, তারা একসঙ্গে চ্যাপলিনের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘মর্ডান টাইমস ও দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ পর্দা ভাগ করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে বিয়ে হয়ে এটি টিকেছিল ৬ বছর। তবে শেষমেশ চার্লি মননিবেশ করেন তার চতুর্থ ও শেষ স্ত্রী উনা ওনিলের উপর। ১৯৪৩ সালে সম্পন্ন হওয়া বিয়েটি টিকেছিল তার মৃত্যু দিন পর্যন্ত। চার্লির ভাষ্যমতে, উনাই ছিল তার জীবনের আদর্শ জীবনসঙ্গিনী।
উনিশ বছর বয়সে চার্লির আমেরিকায় পাড়ি জমানোই তার সাফল্যের সূত্রপাত, বিশ্বজোড়া খ্যাতির সূচনা ছিল সেখান থেকেই। হলিউডে নির্বাচক চলচ্চিত্রের যুগে অভিনয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেন চ্যাপলিন। যুক্তরাষ্ট্রের থাকার সময় চার্লি চ্যাপলিন ৮০টিরও বেশি সিনেমা নির্মাণ করেন যার চিত্রনাট্যও তিনি তৈরি করতেন। আর বলাই বাহুল্য সিনেমাগুলোতে মূল অভিনেতা হিসেবে দেখা যেতো তাকেই। জীবদ্দশায় চ্যাপলিন বরাবরই অস্বীকার করেন তিনি একজন কমিউনিস্ট। কিন্তু ১৯৫০ সালের দিকে তাকে নিয়ে গুজব ও কেলেঙ্কারির ঘটনা বেড়েই চলে। অগত্যা নববিবাহিত চতুর্থ স্ত্রী উনাকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করে ইউরোপে চলে যান চ্যাপলিন।
শেষ বয়সে চ্যাপলিনের ভাগ্যে লেখা ছিল পুরস্কারের ফুলঝুরি। ১৯৭১ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে লেজিওঁ দনরের কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। পরের বছর জেতেন ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের বিশেষ গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার।
১৯৭২ সালে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস চ্যাপলিনকে সম্মানসূচক অস্কার পুরস্কারে ভূষিত করে। এটির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হওয়ার প্রায় ২০ বছর পর মার্কিন মুলুকে প্রত্যাবর্তন হয় তার। ৪৪তম একাডেমি পুরস্কার আয়োজনে তাকে ১২ মিনিট দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো হয়, যা একাডেমি পুরস্কারের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত দীর্ঘতম সময় নিয়ে কাউকে সম্মাননা প্রদর্শন। ১৯৭৫ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ চ্যাপলিনকে ব্রিটিশ সম্মানসূচক নাইটহুডে ভূষিত করেন। আমেরিকা সফরের পাঁচ বছর পর ১৯৭৭ সালের বড়দিনে সুইজারল্যান্ডের বাড়িতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তী। ২৫শে ডিসেম্বর ভোরে ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করে জীবনাবসান হয় তার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। চ্যাপলিনকে সমাধিস্থ করা হয় কর্সিয়ের-সুর-ভেভি সমাধিতে। তার দীর্ঘ কর্মজীবনের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৭৫ বছর।
চ্যাপলিন যে রসিক ও মজার মানুষ ছিলেন তার বহু গল্প প্রচলিত আছে। এমনই একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যখন তার প্রথম দেখা হলো তখন আইনস্টাইন চ্যাপলিনকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমি যে কারণে খুব পছন্দ করি তা হলো আপনার বিশ্বজনীন ভাষা। আপনি যখন অভিনয় করেন, তখন আপনি হয়তো কোনও ডায়লগই বলছেন না, কিন্তু সারা পৃথিবীর মানুষ ঠিক বুঝতে পারে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন এবং তারা সেজন্য আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। উত্তরে চ্যাপলিন মুচকি হেসে বলেছিলেন- ড. আইনস্টাইন, আপনাকে আমি তার চেয়েও বড় কারণে পছন্দ করি। আপনার থিওরি অব রিলেটিভিটিসহ অন্যান্য গবেষণার বিন্দুবিসর্গও কেউ বোঝে না, তবুও গোটা পৃথিবীর মানুষ আপনাকে শ্রদ্ধা করে!’
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২১
জেআইএম