ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে, ‘কিক’ পাচ্ছি না! শুরুর দিকে কিছু পর্ব পর্যন্ত অনেকটা এমনই বোধ হচ্ছিল। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছিল ততই ফুটে উঠছিল সিরিজটির আসল মহত্ত্ব।
পর্দায় ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হচ্ছিল মধ্যবিত্তের সাধারণ এক গল্পকে অসাধারণ হয়ে ওঠা। ড্রামা জনরা থেকে অবশেষে গল্প রূপ নিলো থ্রিলারে।
বলছিলাম ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জি ফাইভ-এ মুক্তিপ্রাপ্ত মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’ নিয়ে। ভারতীয় প্ল্যাটফর্মে দেশি নির্মাতার নির্মিত সিরিজটি বিনামূল্যে দেখা যাচ্ছে গত ৯ জুলাই থেকে।
সিরিজটি দর্শন শেষে এর নাম, যা কিনা বাল্যকাল থেকে সম্বোধনে বহুল প্রচলিত হয়ে আসছে, সেই লাইনটি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হলাম। লেডিস কোনো বিশেষণ ছাড়া শুধুই লেডিস, কিন্তু ম্যানের আগে জেন্টল কেন? তার মানে কি লেডিসরা জেন্টল নয়! যদিও অনেকের মতে লেডিস বলতে সম্ভ্রান্ত নারীদেরকেই বোঝানো হয়, তবুও শব্দটি থেকে একতরফা জেন্টল ফেলে দেওয়ার ব্যাপারটি মোটাদাগে সমীচীন নয়।
আট পর্বের সিরিজটির গল্প সাবিলা নামের এক সাধারণ বিবাহিত মধ্যবিত্ত নারীকে ঘিরে। কর্মসূত্রে তিনি সংস্কৃতি কেন্দ্রে নাচ শেখান, সংসারে বাড়তি খরচ সামলাতে সেলাইয়ের কাজ করেন সাবিলা। প্রতিভা থাকা স্বত্বেও চাকরিতে তাকে পার্মানেন্ট করা হয় না। কেন্দ্রটির চেয়ারম্যান কবি খায়রুল আলম সুযোগ পেয়ে তাকে দু’বার ধর্ষণের অপচেষ্টা চালায়। অভিযোগ করে সাবিলা, শুরু হয় বিচারের নামে প্রহসন। এরমধ্যে হঠাৎই ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে।
সিরিজটির অভিনয়শিল্পীরা প্রত্যেকের নামের প্রতিই যে সুবিচার করেছেন এটা বলার অবকাশ নেই। তবে সেরা তিন এর তালিকা করলে সেখানে থাকছেন যথাক্রমে খায়রুল আলম চরিত্রে আফজাল হোসেন, সাবিলা চরিত্রে তাসনিয়া ফারিণ, মিজু চরিত্রে হাসান মাসুদ।
১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের নাটকে কিংবদন্তি সুবর্ণা-আফজাল জুটির পর সম্ভবত এই প্রথম মন ভরে আফজাল হোসেনের অভিনয় দেখার সৌভাগ্য হলো এদেশের দর্শকের। আবারও প্রমাণিত এসব গুণী অভিনেতাকে স্থান, কাল পাত্রে আটকে রাখা যায় না, শুধু প্রয়োজন হয় যে কোনো একটি মঞ্চের। সিরিজে অতিথি চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর উপস্থিতি তাৎপর্যহীন হলেও দর্শকমনে বাড়তি একটা ভালোলাগার মাত্রা যোগ করেছে। আর পরিচালক পত্নী ও সুঅভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশাকে সাবিলা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হলেও শেষমেশ তিনি বনে যান সিরিজটির প্রযোজক।
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’-এর আরও উন্নতির দিক নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই আসবে সিরিজটির প্রাক্কালের পর্বগুলোর গল্প বলার গতি নিয়ে। প্রযুক্তি বিকাশের এই যুগে যেখানে দর্শকের কাছে সারা বিশ্ব উন্মুক্ত, সেখানে দর্শককে শুরু থেকে পর্দায় চুম্বক দিয়ে আটকে রাখার প্রয়াসে গল্প বলার ঢং এবং অপেক্ষাকৃত লম্বা সব শটে সরয়ার ফারুকী নিজের সিগনেচার রাখতে গিয়ে গল্প বলার গতিকে স্লথ করেছেন বটে। অপরদিকে প্রত্যেক পর্বের শুরুতে সাদামাটা কালো স্ক্রিনে টাইটেল দেখানোকে নিজেদের সামর্থ্যের শতভাগ দেওয়ার ঘাটতি বলে মনে হয়েছে।
নির্মাতা ফারুকী সিরিজটি নিয়ে জানান, ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সত্য ঘটনাই তাকে সিরিজটি নির্মাণের প্রেরণা জুগিয়েছে। সেই ঘটনা তার মস্তিষ্কে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে সেই ভাবনা দর্শকদের মধ্যে সংক্রমিত করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। ভাবনার সংক্রমণে তিনি যে অনেকাংশেই সফল তা সিরিজটি শেষে দর্শক হিসেবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারছি। সিরিজটির শেষে জোর পেয়েছে একজন নারীসত্তার অপমানের প্রসঙ্গটি।
কখনো কখনো স্মৃতি হারিয়ে ফেলাই ভালো!
সিরিজটির শেষ দৃশ্যে স্মৃতিভ্রষ্ট অসুস্থ বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকড়ে কাঁদে সাবিলা এমন কথাটিই মনে মনে বলে ওঠে। কেন না এই স্মৃতির মাঝেই তো লুকায়িত আছে জেন্টলম্যান রূপী পুরুষের ইগোতে নারীর জীবনকে নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত করার ইতিহাস, যেটিকে নারী স্বভাবতই ভুলে থাকতে চায়।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০২১
জেআইএম