কুমিল্লা: মেলামচর গ্রাম। এক সময় যে গ্রামে প্রবেশ করলেই প্রত্যেক বাড়ি থেকে ঠকঠক শব্দ ভেসে আসতো।
চারদিকে খাল-বিল ঘেরা কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ছালিয়াকান্দি ইউনিয়নের মেলামচর গ্রাম। পাঁচদশক ধরে এ গ্রামটি নৌকা তৈরির জন্য সুপরিচিত। এ গ্রামের ৩৬০টি ঘরে বছরের ৯ মাস নৌকা তৈরি হত। প্রায় ৪ শতাধিক পুরুষ এ পেশায় জড়িত ছিল।
চান্দিনা উপজেলার শুহিলপুর এলাকা, মধ্যগ্রাম ও মুরাদনগর উপজেলার আরো কয়েকটি এলাকায় নৌকা তৈরি হলেও মেলারচরই ছিল প্রসিদ্ধ।
কালের বির্বতনে এবার হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্পটি। নৌকা তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি ও আর্থিক অনটনের ফলে এ শিল্পের কারিগররা এখন পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে নৌকা শিল্প। মেলামচর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে এমনটাই দেখা গেল।
বর্তমানে মেলামচর গ্রামের ৩টি পরিবারের ৮ জন এ পেশায় জড়িত। শত অভাব-অনটনের মধ্যেও তারা ঐতিহ্যবাহী পেশাটি এখনও আকঁড়ে ধরে আছে। বাকী কারিগররা এখন পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে। গত ৮ বছরে এ পেশার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পেশা ছেড়ে দিয়েছে প্রায় পৌনে চারশ কারিগর।
স্থানীয় বাসিন্দা কমল দাস বাংলানিউজকে জানান, এক সময় বিয়ে-শাদিতে এক গ্রামের বরযাত্রী অন্য গ্রামে সারি সারি নৌকা সাজিয়ে নিয়ে যেত। গ্রামগুলোর প্রত্যেক ঘরেই ২/৩টি করে নৌকা ছিল। স্কুল-কলেজ, হাটবাজার, মাল আনা-নেওয়ার কাজে এসব নৌকা ব্যবহার করা হত। গত ৫/৬ বছর ধরে এ দৃশ্য আর দেখা যায় না। ৭/৮ বছরে কিছু রাস্তাঘাট নির্মাণ হয়েছে। তাই নৌকার ব্যবহার কিছুটা কমছে।
তাছাড়া আর্থিক দুরাবস্থা এবং নৌকা তৈরির উপকরণের মূল্য দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় কারিগররা তাদের প্রাচীন এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে।
নৌকা কারিগর রঞ্জিত চন্দ্র সরকার (৫০) বাংলানিউজকে জানান, আমি আমার বাবার কাছ থেকে নৌকা তৈরি করতে শিখেছি। ৩০ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে জড়িত আছি। জানিনা আর কয়দিন থাকমু। যেভাবে কাঠ-যন্ত্রপাতির দাম বাড়ছে তাতে নৌকা তৈরি করে লাভ হচ্ছে না।
এ গ্রামে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের নৌকা তৈরি হয়। ৮ হাত, ৯ হাত, ১০ হাত আকারের নৌকা তৈরি হয়। আবার নৌকার বিভিন্ন নামও দেন এই কারিগররা। এমন একটি নৌকার নাম হল ঘাট বাড়ি কৌশা।
এটি মধ্যম আকারের নৌকা।
একটি ছোট আকারের নৌকাতে মাঝিসহ ৬ জন বসতে পারে। এ নৌকা তৈরি করতে খরচ হয় ৪/৫ হাজার টাকা। বাজারে বিক্রি করে প্রায় ৫শ টাকার মতো লাভ হয়। বড় আকারের নৌকাতে মাঝিসহ ১২ জন বসতে পারে। এটি তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। প্রতিটি নৌকা তৈরি করতে ২/৩ দিন সময় লাগে। এক একজন কারিগর সপ্তাহে ৩/৪টা নৌকা বানাতে পারে।
নৌকা কারিগররা কড়ই কাঠ, রেইন্ট্রি, আম, তুলা কাঠ দিয়ে এসব কাঠ তৈরি করেন।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেকে কড়ই কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরির কথা বলে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে কড়ই কাঠ দিয়ে কেউই নৌকা তৈরি করেনা। নৌকা তৈরি হয় আম, তুলা গাছের কাঠ দিয়ে। একটি নৌকা কমপক্ষে ৩ বছর ব্যবহারের উপযোগী থাকে। এসব নৌকা দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ বাজারে বিক্রি করা হয়। আগে রামচন্দ্রপুর ও কোম্পানিগঞ্জ বাজারে বিক্রি করা হত। এখন আর এই দুই বাজারে নৌকা বিক্রি হয় না।
নৌকা কারিগর রঞ্জিত চন্দ্র সরকার বাংলানিউজকে জানান, এখন নৌকা কারিগরের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন। এ পেশায় টিকে থাকার মত ব্যবস্থা নেই। আগে কাঠের দাম কম ছিল, এখন যে কোনো কাঠের ফুট ৮০০/৯০০ টাকা। আগে তার কাটার কেজি মূল্য ছিল ২০টাকা, এখন ৭০ টাকা। তাছাড়া কাঠের স-মিলেও অনেক টাকা দিতে হয়। তাই এ পেশা অনেকেই ছেড়ে দিছে। আমরা কয়েকজনে বাপ-দাদার এ পেশাটি ধরে রেখেছি।
বিলুপ্ত হতে যাওয়া এ পেশাটি রক্ষার দাবি জানিয়ে নৌকা কারিগর সুরেশ চন্দ্র সরকার বাংলানিউজকে জানান, এ পেশার অবস্থা এখন খুবই নাজুক। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য নৌকা শিল্পটিকে বাঁচানো দরকার। সরকার চাইলে হয়ত আমরা টিকে থাকব। সরকারের উচিত আমাদের এ পেশাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৫
এসএইচ