বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি থেকে ফিরে: ‘পেয়ারা বন্ধনে’ আবদ্ধ বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি। প্রশাসনিকভাবে তিনটি জেলা।
স্থানীয়রা বলছেন, এবার ‘আমড়া বন্ধনে’ হারিয়ে যাওয়ার গল্প। স্বপ্ন দেখছেন বিশ্ব ছোঁয়ার। এ সম্ভাবনাও নেহায়েত কম নয়।
ঝালকাঠির কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলীর আমড়া চাষি রিপন চৌধুরী (৫৭)। তার পাশে নৌকা নিয়ে ভাসছিলেন মলয় হালদার। এসব বিষয়ে তিন নৌকার পাটাতনে বসে বিস্তর কথা হয়। পেয়ারার রাজ্যে তারা আমড়া বিপ্লবের কথা শোনান।
রিপন চৌধুরী ১০ কাঠা জমি লিজ নিয়েছেন এ বছর। আষাঢ়ের শুরুতে যখন ফল ধরার আগ মুহূর্ত তখন কায়দা করে জমির একাংশ নেন ২৫ হাজার টাকায়। কেমন লাভ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ জমিতে ৫০ মণের ওপরে আমড়া ধরবে। ইতোমধ্যে ১০-১৫ মণ বিক্রিও করেছি। ভাদ্রের শেষে এখন আশ্বিন, আমড়ার ভরা মৌসুম। তাই দামও ভালো হবে। এদিকে পেয়ারার মৌসুম শেষ। এবার ব্যবসায়ীরা কেবলই আমড়া নেবেন।
তবে আফসোস করে বলেন, কুড়িয়ানা, আটঘর, ভীমরুলী কিংবা ডুমুরিয়া, বেতলা- যেখানেই বলি না কেন বিপুল উৎপাদিত আমড়া সংগ্রহে এসব এলাকার ব্যবসায়ী-আড়তদার পর্যাপ্ত নয়।
তবুও হাল ছাড়েন না, আশা হারান না। বলে উঠলেন, জলে ভাসা হাটে পেয়ারা যেমন বিক্রি হয় তেমনি আমড়াও। চলে যায় দেশব্যাপী। শুধু তাই নয়, এখানকার আমড়া মরুর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর থেকে বড় বড় জাহাজে।
রিপন জানান, তৃণমূলে অর্থাৎ বাগান থেকে সংগ্রহ করা আমড়া প্রথম দিকে ৩শ’, সাড়ে ৩শ’ টাকা মণ বিক্রি হয়েছে। এখন তা সাড়ে ৪শ’ থেকে ৮শ’র কাছাকাছি। আমড়া পেয়ারার মতো অতিদ্রুত পচনশীল নয়, বিধায় এটি চাষে নূন্যতম লাভ হয়- যোগ করেন তিনি।
নৌকা বেয়ে ভীমরুলী ভাসমান হাটে যাচ্ছিলেন মলয় হালদার। দু’পক্ষের কথা শুনে থমকে দাঁড়ান তিনি। পাড়া শেষ, নৌকায় কেবল আমড়া আর আমড়া। হাটের খানিক আগে, একটু বাঁয়েই তার বাগান। মনোরম সুন্দর পরিবেশ আর পাখির কলকলানির মধ্যে সাত সকালে আমড়াগুলো পেড়েছেন বলে জানান মলয়। একেবারেই তাজা। ছাল ছিলে খণ্ড আকারে কাটতেই রস পড়বে চুইয়ে- এমনটাও বললেন তিনি।
বিক্রি করবেন হাটে, তা চলে যাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে। এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে।
তিনি জানান, গুণ-মান ভালো দেখেই এখানকার আমড়ার চাহিদা আছে। যারা আমড়া কেনেন সবাই চান এই অঞ্চলেরই কিনতে। খাঁটি জিনিসের মূল্যায়নই আলাদা। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের আরও সহযোগিতা করার ওপর জোর দেন মলয়।
এদিকে ভীমরুলীতে বাগান পরিদর্শনে উঠে এলো চাষিদের কিছু সমস্যার কথাও। বর্ষা মৌসুমে এক ধরনের লেদা পোকা গাছের পাতা খেয়ে, পাতাশূন্য করে ফেলে। এতে আমড়া চাষে ক্ষতি হয়। এ জন্য কৃষক-চাষি-বাগানিরা চান স্থানীয় কৃষি অফিসের সহায়তা। কিন্তু সাড়া পান না তেমন। তারা কীটনাশকমুক্ত আমড়া চাষাবাদে আগ্রহী। জানালেন, পূর্ব-পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া এই আমড়া চাষ হোক কোনো প্রকার ওষুধ ও বিষমুক্ত পদ্ধতিতে। তাই তো স্বাদ এতো বেশি। কদর এতো।
ভীমরুলীতে আড়ত ছোট-বড় মিলিয়ে ১০টি। সবাই মূলত পেয়ারা কেনেন। তবে পেয়ারার শেষ সময়ে এসে শুরু হয় আমড়ার ভরা মৌসুম। সে জন্য আড়তদাররা থেকে যান আগের মতোই। চলে আমড়া বিকিকিনির হাঁকডাক।
ডুমুরিয়া, বেতলা, ডালুহারসহ ঝালকাঠির বেশির ভাগ গ্রাম পেয়ারার পাশাপাশি আমড়া চাষের জন্যও বিখ্যাত। বর্তমানে এসব আমড়া বিক্রি হচ্ছে আটঘর, পিরোজপুরের কুরিয়ানাসহ ঝালকাঠির ভীমরুলী জলবাজারে। তবে সবচেয়ে বড় জলবাজার ভীমরুলী। এখানকার জৌলুসই আলাদা। সকাল ৮টার মধ্যে বাজার বসে, বেচাকেনা চলে দুপুর পর্যন্ত। এছাড়া ঝালকাঠি হয়ে জলপথে কিংবা সড়ক পথে সোজা বরিশাল অথবা পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি দিয়ে গরিয়ারপাড় থেকে বরিশাল সদরে প্রবেশ করছে এসব অঞ্চলের সুস্বাদু ফল আমড়া। যা পরে চলে যাচ্ছে রাজধানীসহ বিভিন্ন বড় শহরে।
এদিকে বরিশালের সদর উপজেলা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, কাউখালী এবং ঝালকাঠি সদর, রাজাপুর ও নলছিটিতে আমড়ার আবাদ হয় বাম্পার। এসব অঞ্চলের দেড় হাজার একরেরও বেশি জমিতে সরাসরি আমড়া চাষ হচ্ছে।
স্বরূপকাঠির কুড়িয়ানাতেও আমড়া বিক্রির জন্য রয়েছে ভাসমান হাট। ছোট ডিঙিতে বা নৌকায় করে চাষি-বাগানিরা আসেন এখানে। আর ট্রলারে করে আড়তদাররা তা কিনে নেন। সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে গেছে খাল। খালের নাম স্থানের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার খেয়াঘাট পেরিয়ে মাহমুদকাঠি, কুড়িয়ানা, আটঘর, ধলহার, ব্রাহ্মণকাঠি, আদমকাঠি এরপর পাশের জেলা ঝালকাঠি। তার দুই-এক কিলোমিটার পরেই ভীমরুলীতে প্রবেশ। এসবই ভাসমান হাট। পুরো আশ্বিন জুড়েই আমড়া বিক্রিতে এসব হাট জমজমাট থাকবে। তবে পেয়ারার মতো এতোটা গমগমে হবে না, তাও বা কম কী।
ভীমরুলীর আড়তদার লিটন হালদার। তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যও বটে। কথা হয় তার সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আশ্বিন মাস আমড়ার ভরা মৌসুম। এ সময় যত আমড়া এই অঞ্চলে উৎপাদিত হয়, এমনটা সারা বাংলাদেশে আর কোথাও হয় না। দেশব্যাপী দক্ষিণের আমড়ার সুনাম রয়েছে। বিশ্বজুড়ে খ্যাতিও।
তিনি জানান, বর্তমানে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মণ আমড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর পাঠাচ্ছেন। বস্তা হিসেবে আমড়া যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। বস্তা প্রতি আড়াই মণ। দাম ৭শ’ থেকে ৮শ’র মধ্যে। আশ্বিনের শেষভাগে যখন আমড়া শেষের দিকে থাকবে তখন এই দাম আরও বাড়বে বলে মত তার।
চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে কাঁচা আমড়া ও প্রক্রিয়াজাত আমড়া বিভিন্ন দেশে যায়। তবে খুব কম। এছাড়া লন্ডনেও সম্প্রতি এ অঞ্চলের আমড়া রফতানি হচ্ছে। যা আরও ব্যাপক আকারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মত দেন আড়তদার লিটন।
আরেক আড়তদার আবদুর রহিম বেপারী জানান, তিনি স্বরূপকাঠি দিয়ে লঞ্চে আমড়া পাঠান। সরাসরি তা ঢাকার লালকুঠি-শ্যামবাজারে পৌঁছে। চাহিদা ভালো, সেখানে ৪নং ঘরের, আরব আলী তার বেশ কয়েকদিনের চালান অগ্রিম কিনে রেখেছেন। এদিন সাড়ে ৬শ’ দরে ৩১ মণ আমড়া পাঠান ঢাকায়। আর কয়েকদিন পর চট্টগ্রামেও যাবে তার আমড়া।
পাঠানোর খরচ বিষয়ে আবদুর রহিম বলেন, এক বস্তায় দুই মণ আমড়া পাঠাতে খরচ ৫০০ টাকা। সরকার থেকে যদি সরাসরি আমড়া কিনতো অথবা বড় ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সরাসরি নিয়ে যেতেন তবে এর প্রচার-প্রসার আরও বাড়তো। বিদেশে রফতানির পরিমাণও বৃদ্ধি পেতো।
কীর্তিপাশা থেকে শামীম আমড়া নিয়ে এসেছেন ভীমরুলী হাটে। রোজই আসেন। দৈনিক তার সরবরাহ দুই থেকে চার মণ। দাম চান সাড়ে ৮শ’ করে।
মো. ইয়াসীন (২০) চাষি নন। বাগান থেকে সরাসরি আমড়া কিনে বিক্রি করতে এনেছেন হাটে। ১০ থেকে ১১ মণ হবে তার নৌকায়।
ইয়াসীন জানালেন, ঝালকাঠির রাজাপুর থেকে প্রতি মৌসুমে হাজার হাজার বস্তা আমড়া জেলা শহর, ভান্ডারিয়া কিংবা কাউখালী হয়ে লঞ্চযোগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। সুমদ্রবন্দর দিয়ে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশেও এই দক্ষিণের আমড়া রফতানি হচ্ছে কয়েক বছর হলো, শুনেছেন তিনি।
আমড়া সংরক্ষণ করা যায় সহজে। দ্রুত পচে না, কাঁচা লবণ-মরিচ দিয়ে খাওয়া যায়, ঝাল-টক-মিষ্টি আচার বানানো যায়, চাটনি তৈরিসহ মোরব্বা তৈরিতেও আমড়ার বিকল্প কমই। তাই এর চাহিদা প্রচুর বলে জানালেন, স্থানীয় চাষি-বাগানি এবং ব্যবসায়ী-আড়তদাররা। সরকারের খানিক উদ্যোগ ও গুরুত্বই পারে এসব এলাকার আমড়ায় সম্ভাবনার দ্বার আরও উন্মোচিত করতে। এতে অর্জিত হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা। সার্বিকভাবে সারাবিশ্ব ছোঁয়ার প্রতিশ্রুতি খেটে খাওয়া এই কৃষকদের।
আমড়ার পুষ্টিগুণ
পুষ্টিবিদরা বলেন, একটি আমড়ায় তিনটি আপেলের সমান পুষ্টিগুণ। গবেষণায় দেখা যায়, আপেলের চেয়ে আমড়ায় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রন বেশি। এই ফলটিতে উৎকৃষ্টমানের শর্করা, আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্যারোটিন, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি ছাড়াও হরেক রকমের খনিজ পদার্থ রয়েছে।
আমড়া ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ উৎস হিসেবেই বেশি পরিচিত। শুধু তাই নয়, আমড়ায় থাকা খাদ্যের ভিটামিন-এ ও ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া সর্দি কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভিটামন-সি অত্যন্ত উপকারী। আমড়ায় থাকা ক্যালসিয়াম মাংশপেশিতে খিচুনি প্রতিরোধ করে এবং শিশুদের দৈহিক গঠনকে পোক্ত করে। সেই সঙ্গে প্রচুর আয়রন থাকায় রক্ত স্বল্পতায় ভোগা রোগীদের উপকারে আসে ফলটি। এছাড়া আমড়া বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে পাকস্থলিকে সুস্থ রাখতেও সহায়তা করে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৫
আইএ/জেডএম
** জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে আগ্রহ
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’