ভীমরুলী (ঝালকাঠি) থেকে ফিরে: শহরে সূর্য কিরণ ঢাকা পড়ে বড় বড় দালানে। আর এখানে কিরণ আড়াল হয় গাছের ডালে।
গ্রামের স্নিগ্ধ মায়ার বাঁধনে জড়ানো পরিবেশ। স্বচ্ছতার আলোয় উদ্ভাসিত সকাল। শাঁ শাঁ শব্দে বাতাসের এলোমেলো ছুটে চলা। মধ্যদুপুরে বালু পথে চিকচিক বিকেলের সোনা রোদ এবং গোধূলি ক্ষণ, রাতে ঝিঝি পোকার ডাক, চাঁদের মায়াবি আলো। থেকে থেকে কাঁচা মাটির সোঁদা গন্ধ। খাল বয়ে চলে কুলকুল, চতুর্দিক বেষ্টিত ঘন গাছপালায়। আরও কত কী! যেন ছবিকেও হার মানায়।
অপরূপ বাংলার একখণ্ড প্রতীমা ভীমরুলী। দক্ষিণ অঞ্চলের জেলা ঝালকাঠির একেবারে শেষ প্রান্তের গ্রাম। কীর্তিপাশা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। সময়টা তখন দুপুর-বিকেলের মধ্যখানে আটকে। রোদ প্রখর। গায়ে বাতাস লাগানোর মতো দমকাও বইছে না তেমন একটা। তাতে তো আর ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি’ প্রণব গা ঘামিয়ে বসে থাকতে পারেন না! দিলেন হেইয়ো ঝাঁপ...
শিশু বয়সের ছেলেমানুষি আর কি। যেমন লাফা-কুদা; তেমনি নিজের পরিচয়টাও অন্যরকমভাবে দেওয়া! আসলেই তার নাম প্রণব। তবে ভারতের নয়, ভীমরুলীর প্রণব। স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
গ্রামের পূর্ব অংশে পিরোজপুর থেকে বয়ে আসা সন্ধ্যা নদীর অববাহিকা হয়ে খাল গিয়ে পথ খুঁজেছে। নিজেকে শূন্যে ভাসিয়ে সে খালেই ঝাঁপ প্রণবের। এই খালটি আবার সোজা চলে গেছে নলছিটি উপজেলায়, এরপর বরিশালে ঢুকেছে। ব্যাখ্যায় সময় লাগলেও ঝাঁপে নয়, কেননা সেকেন্ড ৩০’র মধ্যে খাল পাড়ের উঁচু মাটি ও নুয়ে পড়া গাছ থেকে একে একে ঝাঁপ উজ্জ্বল হালদার, চয়ন, সুজিত ও হৃদয় ভক্তের।
সবাই একই পাড়ার। গোসলেও তাই সবাই মিলে। সঙ্গে আরও নেমেছে ছুঁচালো লাঠি ও কলাগাছ। খালে নেমে হচ্ছে গোসল, চলছে খেলা। সংলাপ শুনেই বোঝা গেলো, মহাভারত মঞ্চস্থ হচ্ছে খালের জলে! কৌরব-পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলির এক একটি সংলাপ আধো আধো উচ্চারণ আর স্নানে মাতা শিশু-কিশোরদের।
কথা হলো খালে নেমে। উজ্জ্বল বেশ দুরন্ত। পানি ছিটিয়ে-ছিটিয়ে উত্তর- ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। তার দূর-সম্পর্কের ভাই চয়ন সপ্তম শ্রেণিতে। সুজিত অষ্টম আর হৃদয় ভক্ত ষষ্ঠ।
উজ্জ্বলের বাবা কীর্তিপাশা গালর্স স্কুলের শিক্ষক। গেলোবার তাদের পেয়ারা ও আমড়া বাগান ছিল, এবার নেই কারণ লিজ দেওয়া হয়েছে। ভীমরুলী দক্ষিণদ্বারে বাড়ি তাদের।
এদিকে চয়নের বাড়ি ভীমরুলীর কাপড়কাঠিতে। বাবা গ্রামের কে এম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কর্মচারী। অন্যদিকে সুজিতের বাবা সুকণ্ঠ হালদারের বিশাল আমড়া বাগান। করেন দেখাশোনা এবং হৃদয়ের বাবা চিত্তরঞ্জন ভক্ত ব্যবসায়ী।
কথা বলে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় কখনও যাওয়া হয়নি কারো। ভবিষ্যতে একদিন তো যেতেই হবে এমনও মত তাদের। তবে গ্রামের যে কী যাদু তা কোথায় পাবে কেউ!
অলিখিত দলনেতার ভূমিকায় থাকা উজ্জ্বলের বক্তব্য, বিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন তাদের সবার। একেক বন্ধু একেক বিষয়ে ডাক্তার হতে চায়। এ জন্য চলছে মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা।
কণ্ঠে বলিষ্ঠতা। বহিঃপ্রকাশ যেন- গ্রামের ছেলে তাতে কী, হতে হবে বড়। শহর শাসনের বুদ্ধি-জ্ঞানের ভরপুরতা অর্জন করতে হবে।
ইট-কংক্রিটের শহরের কৃত্রিম ও মেকি সভ্যতার বাইরে এই শিশুদের জীবন। গ্রামের স্বভাবসুলভ সৌন্দর্যের রূপে মুগ্ধ তাদের মন। কলসী কাখে রূপসী নারীর হেঁটে চলার মতো পবিত্রতায় এখানে বেড়ে ওঠা। এমনটি কোথায় আছে আর! পেয়ারা-আমড়া বনের অভ্যন্তর থেকে পাকার মাদকতাময় মন ভোলানো শৈশব-কৈশোর একি হারাতে পারে! প্রকৃত শৈশব কিংবা কৈশোর এখানেই তো আবদ্ধ। শহুরে জীবনে শৈশব-কৈশোর আর কই!
এ যুগে যেখানে শৈশব হারায় না, তারই কাণ্ডারী উজ্জ্বল বলে উঠলো, আমাদের স্কুলের স্যার প্রায়ই বলেন- আমরা নাকি জীবন পেয়েছি। পাখির মতো মানব জীবন! মাছের মতো লাফালাফির জীবন!
-হিহিহি... হৃদয় ভক্তের হাসি। আমরা ছেলে-পুলে মানুষ, পাখি হলাম কবে, আর মাছই বা হলাম কবে! স্যারও যা বলেন না।
-আমরা ভোরে উঠে খেলি, মাঠে দৌড়াই, দুপুরে স্কুল। এরপর বিকেলের আগে আগে খালের জলে ভাসি, খেলি, বেড়াই। সন্ধ্যায় পড়তে বসি। রাতে দেখি পূর্ণিমা, বললো চয়ন।
এবার প্রশ্ন সুজিতের, স্যার ক্লাসে বলেন- এমন সময়-মুহূর্ত শহরের ছাত্র-ছাত্রীরা পায় না। আমি সেটাই বুঝি না, শহরে কি জলকেলির জল নেই? ওঠে না সূর্য, হয় না ভোর, ডাকে না পাখি, তাও কেন তারা জীবন পায় না আমাদের মতো...
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৫
আইএ/জেডএম
** তিন মাস চা বিক্রেতা, নয় মাস মজুর
** ‘আমড়া বন্ধনে’ সম্ভাবনা বিশ্ব ছোঁয়ার
** জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে আগ্রহ
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’