ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

একটু অসাবধানতায় বিষাদের ছায়া!

সাখাওয়াত আমিন, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫
একটু অসাবধানতায় বিষাদের ছায়া! ছবি: সাখাওয়াত আমিন / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বিশ্বস্ত প্রাণীর তালিকায় কুকুরের সুনাম সর্বত্র। যারা প্রভুর জন্য প্রয়োজনে জীবনও বিলিয়ে দেয় অকাতরে।

প্রজাতি নির্বিশেষে সব দেশের কুকুরের মাঝেই এ গুণটি দেখা যায়। তবে লাখ টাকার বিদেশি কুকুরের স্থান ধনীদের বেডরুমে হলেও দেশীয় প্রজাতির কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এঁটোকাটা আর লাথি-গুতো খেয়ে জীবন কাটানোই যেন দেশীয় কুকুরগুলোর নিয়তি।

তবে নিয়তির বাইরেও কখনও কিছু ঘটনা ঘটে। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছে জাতীয় প্রেসক্লাবে। মাস দুয়েক হলো সাতটি ছানা নিয়ে একটি মা কুকুর আশ্রয় নিয়েছে প্রেসক্লাবের পূর্বপাশের অব্যবহৃত কালভার্ট পাইপের ভেতরে।
 
প্রেসক্লাবের এ জায়গাটি বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফারদের আড্ডার স্থান। প্রেসক্লাবের বিভিন্ন মিলনায়তন ও আশেপাশের ঘটনাগুলো কভারের ফাঁকে ফাঁকে এখানে বসেই সময় কাটে তাদের। কুকুরটি ছানাগুলো নিয়ে মাঝে মধ্যেই পাইপের ভেতর থেকে বের হয়, ছানাদের দুধ পান করায়। ছানাগুলোও এদিকে সেদিক ছুটোছুটি করে খেলে।

প্রাণিদের মধ্যে যে স্বাভাবিক মানুষভীতি থাকে তার ছিটে-ফোটাও নেই এই কুকুর ও তার ছানাগুলোর মধ্যে। প্রেসক্লাবে নিয়মিত আসা সাংবাদিকরাও আর দশটি কুকুর থেকে আলাদা চোখে দেখেন এ কুকুর পরিবারটিকে। কখনও কেউ তাদের আঘাত করেন না। অনেকে সুন্দর ও হৃষ্টপুষ্ট ছানাগুলোর গায়ে ও মাথায় হাত বুলিয়ে আদরও করেন। অনেকে গাঁটের পয়সা খরচ করে খাবারও কিনে দেন তাদের।

অন্যান্য দিনের মতো বুধবার(২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরেও ছানাগুলোকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে তাদের বুকের দুধ পান করাচ্ছিল মা কুকুরটি। সেখানে আড্ডারত ছিলেন দশ-বারোজন রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফার। সবাই এ অকৃত্রিম মাতৃত্ব উপভোগ করছিলেন। কোন ছানাটি বেশি সুন্দর, কোনটির তেজ বেশি, কোনটি স্বাস্থ্যবান এ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে আলাপও করছিলেন তারা।

দুধপান শেষে খেলতে খেলতে পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা একটি গাড়ির নিচে আশ্রয় নিল ছানাগুলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িটির চালক এসে গাড়িটি স্টার্ট করলেন। স্টার্টের শব্দ পেয়েই উপস্থিত সাংবাদিকরা গাড়ির নিচে থাকা কুকুর ছানাগুলোর ব্যাপারে চালকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন।

চালক আগে পিছে না তাকিয়ে হঠাৎ করেই গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। গাড়ি দু’হাত না এগোতেই তার নিচে চাপা পড়ল সবচেয়ে সুন্দর সাদাকালো ডোরাকাটা বাচ্চাটি।

উপস্থিত সাংবাদিকরা এ অমানবিক দৃশ্য দেখে নিজেদের স্থির রাখতে না পেড়ে দৌঁড়ে গিয়ে গাড়িটি থামালেন। এ মর্মান্তিক ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে কয়েকজন চালককে মারতেও উদ্যত হলেন। তবে চালক দুঃখ প্রকাশ করলে কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের মধ্যস্থতায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল গাড়িটি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার।

চাপা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি থামানোয় ছানাটি প্রাণে বাঁচলেও হারাতে হয় একটি পা। পাশেই থাকা ছানাটির মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে তখন আশ্চর্য নীরবতা! আনন্দ উৎসবে মেতে থাকা একটি পরিবারে যেন হঠাৎই নেমে এল বিষাদের কালো ছায়া। মা কুকুরটি লেজ নেড়ে বেদনার্ত ঘেউ ঘেউ ডাকে যেন বলছিল, দেখো, তোমরা মানুষরা কতো নিষ্ঠুর। তোমাদের একটু অসাবধানতা আমার অসহায় ছানাটির পা কেড়ে নিল মুহূর্তেই।

এরপর নিজের মুখ দিয়ে পঙ্গু ছানাটিকে তুলে আবার সেই পাইপের মধ্যে প্রবেশ করে কুকুরটি। সঙ্গে প্রবেশ করে পরিবারের অন্য সদস্যরাও। সবাই মিলে যেভাবে পারছে আহত সদস্যটিকে আদর দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্য সময়ে মায়ের দুধ নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়লেও এখন আর সে কাড়াকাড়ি নেই ছানাগুলোর মধ্যে! আহত ছানাটি একাই পান করছে মায়ের দুধ। বাকি ছয়টি ছানা তার সেবায় নিয়োজিত!

ঘটনাটি যেন ছেদ ঘটালো সাংবাদিকদের প্রাণবন্ত আড্ডায়। চোখের সামনে এমন মর্মান্তিক একটি ঘটনায় বিষাদ যেন ছড়িয়ে পড়লো তাদের মধ্যেও। সবাই নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন কুকুর পরিবারটির পরস্পরের প্রতি এ অকৃত্রিম ভালোবাসা। অবিবেচক চালকের প্রতি ক্ষোভও প্রকাশ করলেন উপস্থিত সবাই। কাছের পশু ডাক্তারের ফোন নম্বরের খোঁজও করতে দেখা গেল কয়েকজন সাংবাদিককে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫
এসএ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।