খুলনা: রঙ্গন, জবা, বুনো ফুলসহ নানা রঙের ফুল এখনও ফোটে, ওড়ে প্রজাপতি, ডাকে পাখি। ফুল, প্রজাপতি ও পাখিতে সেই আগেরই আবেগ-আবেদন রয়েছে।
জোড়াগেট এলাকায় ১৯০৫ সালে যখন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এদেশে প্রভাব ফেলেনি সে সময় প্রায় ৫ একর জমির ওপর পুষ্পশোভিত প্রেমকানন গড়ে তোলেন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী মঙ্গল চাঁদ চুনিলাল মেহতা। প্রকৃতিপ্রেমী মঙ্গল চাঁদ চুনিলালের বড় ছেলের নাম ছিল প্রেমসুখ মেহতা। তার নামের প্রথম শব্দ দিয়ে অপরূপ এ উদ্যানটির নামকরণ করা হয় প্রেমকানন।
১৯২৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গল চাঁদ প্রেমকানন উদ্যানটি সত্য নারায়ণ মন্দিরকে হস্তান্তর করেন।
এক সময় প্রেমিক জুটিরা প্রেমকাননের প্রকৃতির সঙ্গে মিশে চুটিয়ে করতো প্রেম। সাজাতো তাদের অনাগত দাম্পত্য জীবনের পরিকল্পনা। সব শ্রেণীর প্রেমিক জুটিরা যেন খুঁজে পেতো তাদের আপন ঠিকানা। পাশাপাশি তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ ঘুরতে আসতেন প্রেমকাননে। কিন্তু এখন আর প্রেমকাননে কোনো প্রেমিক জুটির আনাগোনা নেই। নেই তরুণ-তরুণীদের পদচারণা। প্রেমকানন এখন নিষ্প্রাণ।
রোববার (১১ অক্টোবর) দুপুরে প্রেমকাননে সরেজমিনে গেলে উদ্যানটির মালি শিবু রায় বাংলানিউজকে এমনটিই জানালেন।
মন্দিরের পূজার জন্য ফুলের মালা গাথা অবস্থায় তিনি বলেন, রঙ্গন, জবা, কামিনী, বুনো ফুলসহ বর্তমানে ১০-১৫ ধরনের ফুল গাছ আছে এ কাননে। ঘন সবুজ কামিনী ফুলগাছ ছেঁটে অদ্ভুত শিল্পদক্ষতা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি তৈরি করা আছে। কাননের চারদিকে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল, ফল, বন ও ঔষধি গাছের সমারোহ।
তিনি আরও বলেন, এক সময় কামিনী গাছ দিয়ে তৈরি করা ছিলো মহাদেবের মন্দির, হাতি, ঋষি কুঠির, বানর, কুকুর, পরী, নৌকা, পাহারাদার, কালিয়াদমন, ভারতমাতা সিংহ বাহিনী, ময়ূর ও শিকারি, কাক, দফতরখানা, বলদ, উট ও হরিণের প্রতিকৃতি।
শিবু রায় বলেন, রথযাত্রা উপলক্ষে প্রেমকাননে প্রতি বছর আষাঢ় মাসে উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হয়। ওই দিনগুলোতে লোক সমাগম থাকলেও বছরের অন্যান্য সময় থাকে অনেকটা নিষ্প্রাণ।
সরেজমিনে কাননটির ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়লো মাঝামাঝি যাত্রী ছাউনির মতো তৈরি করা একটি ভবন। তাতে খোদাই করে লেখা খুলনা বাজারে স্থাপিত শ্রী শ্রী সত্যনারায়ন ভগবানের চরণ কমলে প্রেমকানন বাগিচা অর্পণ করা হলো। যাত্রী ছাউনির আদলে তৈরি করা ভবনটি ভ্রমণকারীদের ক্লান্তি দূর ও রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
কাননের ভেতরে রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরের ঘাটটি ছাদযুক্ত এবং চমৎকার। সেখানে প্রতিদিন শত শত লোক গোসল করেন। উদ্যানটির চারদিকে উঁচু প্রাচীর। এখানে রয়েছে গাছ দিয়ে ছাত্র-শিক্ষকের পড়ানোর একটি দৃশ্য। একমাত্র প্রবেশপথটি পূর্বদিকে।
জানা গেছে, এ কানন থেকে বড় বাজার সত্য নারায়ণ মন্দিরে পূজার ফুল সরবরাহ করা হতো। সে ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এক সময় প্রেমকাননকে দর্শনীয় করতে ভেতরের দ্বিতল ভবনে লাগানো হয় দুর্লভ সব তৈলচিত্র। ছিল আরও অনেক সংগ্রহশালা; যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লুট হয়ে যায়। পরে অবশ্য ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়।
জনশ্রুতি আছে, এ ভবনের ভেতরে একটি কক্ষের নাম ছিল পরীঘর। কক্ষটি ছিল সুন্দর কারুকাজ খচিত। প্রচলিত রয়েছে এখানে রাতের আঁধারে পরীরা আসত। তারা এসে নাচে-গানে কক্ষটি ভরিয়ে তুলতো।
প্রেমকাননে ঘুরতে আসা মাইজভাণ্ডারির খাদেম হাফিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কি যেন এক টানে আমি প্রায় এখানে আসি। এখানে এলে শান্তি লাগে।
তিনি আরও বলেন, প্রেমিক-প্রেমিকা না এলেও এক শ্রেণীর মানুষ প্রাচীন এই প্রেমকানন দেখতে এখনও আসেন।
প্রেমকানন সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ ফরাজী (৭০) বাংলানিউজকে বলেন, কোনো এক সময় জমজমাট ছিলো এ প্রেমকানন। প্রেমিক-প্রেমিকাদের এখানে না এলে যেন প্রেম জমতো না। এক সময় এখানে বনভোজন ও সাহিত্যের আসর বসতো। তখন প্রেমকানন মুখরিত হয়ে উঠতো হাজার হাজার মানুষের পদচারণায়। প্রেমকাননকে কেন্দ্র করে কয়েকটি ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। তবে হিন্দু ধর্মীয় কয়েকটি অনুষ্ঠানে এখানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়, বসে মেলা।
প্রেমকাননের এমন দশা কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন শহরে অনেক আধুনিক পার্ক হয়েছে। ছেলে-মেয়েরাও হয়েছে অনেক আধুনিক। যে কারণে প্রাচীন এ কাননে তারা আসছে না। এছাড়া এখানে নিরাপত্তারও পর্যাপ্ত অভাব রয়েছে। নেই পর্যাপ্ত বসার জায়গা। নষ্ট হয়ে গেছে দর্শনীয় অনেক জিনিস।
নগর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি মোল্লা মারুফ রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, ভৈরব-রূপসা বিধৌত খুলনার ইতিহাস নানাভাবে ঐতিহ্যমণ্ডিত। যার মধ্যে প্রেমকানন অন্যতম। কালের বিবর্তনে সেটি এখন সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটিকে রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০২১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৫
এমআরএম/এএসআর