ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

গল্প

মাতৃত্ব | আকাশ মামুন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০১ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৭
মাতৃত্ব | আকাশ মামুন মাতৃত্ব

মাতৃত্ব
আকাশ মামুন

বৃষ্টিবিঘ্নিত ছুটির দিন। জ্যৈষ্ঠ মাসের ক্লান্ত বিকেল।

কেমন একটা মায়া মায়া আবহ নিয়ে বিকেলটা জমে আছে গুলশান লেকঘেঁষা বাড়িটির বেলকনিতে। ঝিরঝির বাতাস আর বৃষ্টিতে যৌবন ফিরে পাওয়া লেকের পানি চিকচিক করে মৃদুমন্দ তালে লেকজুড়ে ছোটাছুটি করছে।  কিশোরী যেমন প্রথম শাড়ি পরার দিনে এপাড়া-ওপড়া ঘুরে বেড়ায় এক অনভিজ্ঞ পুলক নিয়ে, ঠিক তেমনটি। পাড়ার কিশোররা হঠাৎ নতুন সাজে, নতুন সৌন্দর্য-সৌকর্যে আবিষ্কৃত কিশোরীর মোহনীয় ঘোরে যেমন মোহিত হয়; তেমনি লেকের পাড়ের গাছগুলোও লেকের পানির এই ঝিরঝির ছুটে চলা দেখছে মোহনীয় চোখে-পুলকিত মনে। ছুটির দিন হলেও কারও কারও ব্যস্ততা যেনো থেমে নেই। গাড়ির পুপু শব্দ, রিকশার টিংটিং বেল, ব্যস্ত পথিকের দ্রুত পায়ে চলা— সে সবই জানান দিচ্ছে। এরকম বিকেলে সারা সপ্তাহের ক্লান্তি মুছে গ্রিনটি হাতে বেলকনিতে বসে এসবই দেখছে বিলকিস শবনম। একটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্তাব্যক্তি। কৈশোর-যৌবনের নানা বাঁক পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠের এই বিকেলের মতোই কিছুটা ক্লান্ত। ক্লান্ত বিকেলের ক্লান্তি দূর করতে কখনও কখনও ঝিরঝির বাতাস হাত বাড়িয়ে দেয়। কখনও ঈশান কোণের মেঘ অথবা এক পশলা বৃষ্টি বিকেলকে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু চল্লিশোর্ধ্ব বিলকিস শবনমকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার কেউ নেই। সেই ছোঁয়ার সুযোগটা তিনিই রাখেননি বলা যায়। চল্লিশ পেরিয়ে তিনি এখনও একা থাকেন। একা থাকাটা যে তার কাছে খারাপ লাগছে তা কিন্তু নয়— বরং তিনি উপভোগই করছেন। স্বাধীন এবং ঝঞ্ঝাটহীন।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উচ্ছ্বল আর স্বাধীনচেতা জীবনে পরাধীনতা আর শৃঙ্খলের লাগাম এখনও অব্দি কল্পনা করতে পারেননি। তার কাছে বিয়ে মানেই একটা সংসার, একটা অদৃশ্য পিছুটান, পরাধীনতা, শৃঙ্খলিত জীবন। তাই সংসার আর তাকে টানে না। সংসার করার সুযোগটা দিন দিন আরও সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হতে চলছে। যদিও পঁয়তাল্লিশ বা তদোর্ধ্ব বয়সে এখন বিয়ে করছে অনেকেই। এইতো সেদিন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সাতচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করলেন এক মন্ত্রীকে, বলিউডে তো অহরহই হচ্ছে। তবু বিলকিসের এ জীবনে আর গোছানো সংসারী হতে ইচ্ছে করে না।  

ইচ্ছে আর স্বপ্ন একদিন ছিলো না তা নয়, তবে আজ আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণিল জীবনে অনেকেই বন্ধু ছিলো। ফারহান সবার মধ্যে থেকেও সবার চেয়ে আলাদা ছিলো বিলকিসের জীবনে। যদিও সম্পর্কটা টম আর জেরির মতোই ছিলো। সব কিছুতেই যুক্তি-তর্ক তাদের থাকতোই। পড়া-লেখাতেও ফারহান কখনও পেরে উঠতো না বিলকিসের সঙ্গে। একটা পরীক্ষায় বেশি মার্কস পেলে দেখা যেতো পরের পরীক্ষায় আবার বিলকিস টপকে গেছে ফারহানকে। পছন্দ-অপছন্দগুলোর কোনো মিল ছিলো না। তারপরও কোথায় যেনো একটা ছন্দ ছিলো। কোথাও যেনো একটা সুর বাজতো। গভীর রাতে ল্যাম্পপোস্টে সোডিয়াম আলো জ্বেলে শহর যখন তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে, তখন হঠাৎ ঘুম ভেঙে অতি দূরে কোথাও বেজে চলা একটানা বাঁশির সুরের মতো একটা কিন্নর সুর বাজতো তাদের মধ্যে। কোনো কোনো দিন ফোনে ঝগড়া চলতো গভীর রাত অব্দি। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য সব নিয়ে কথা হতো। ঝগড়া করতে করতে রাতের মতো কথাও যখন ফুরিয়ে আসতো- তখন কথাগুলোও কেমন একটা উপসংহারে চলে আসতো। যা থেকে সহজেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। তখন থেকেই তারা বুঝেছিল, ঝগড়া মানেই বৈপরীত্য নয়, অমিল নয়, বেসুরো নয়। ঝগড়ার মধ্যেও মিল আছে, সুর আছে। নিজেদের শাণিত করা যায়, পৌঁছানো যায় উপসংহারে। শুধু সেই সুর আবিষ্কার করতে জানতে হয়। শুধু সেই উপসংহারে পৌঁছাতে জানতে হয়। এই ঝগড়া আর তর্কে শাণিত হতে হতে, নিজেদের বোঝাপড়াকে এক চূড়ায় নিয়ে যেতে পেরেছিল তারা। যেখান থেকে ঝরনার পানির মতো সব বৈপরীত্য, ছন্দ আর মিলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে নিচে গড়ায়। কেউ কাউকে কোনোদিন বলেনি, তবুও জীবনের বাকিটা পথ এক সঙ্গে চলতে পারবে বলে মনে হয়েছে তাদের।

বিলকিসের বিয়ে নিয়ে উঠে-পড়ে লাগলো পরিবার। আর দেরি করা কেন? বিলকিস এতোদিন পড়াশোনার নাম করে যে সময় নিয়েছিল, তা এখন শেষ। কাজেই আটকানোর আর কোনো পথই খোলা নেই। যতো প্রস্তাবই আসছে, কোনো না কোনো অজুহাতে বিলকিস তা ভেঙে দিচ্ছে। হঠাৎ করেই ফারহানের চাকরিটা হয়ে গেলো। চমকে দিয়ে ফারহান ফোন করে হ্যালো বলতেই শোনালো অঞ্জন দত্তের সেই কালজয়ী গান, চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বিলু শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না। সমন্ধটা এইবার তুমি ভেস্তে দিতে পার, মাকে বলে দাও বিয়ে তুমি করছো না...। ফারহান বিলকিসকে বিলু বলেই ডাকতো। একটা হিম শীতল পরশ বিলকিসের মেরুদণ্ড বেয়ে নিচে নেমে গেলো। কী এক আবেশ, এক অপ্রকাশিত উত্তেজনা বিলকিসকে ঘিরে রাখলো। খুব ছোট ছিলো সেদিনের সেই ফোনালাপ। তবুও মনে হলো, পৃথিবীর দীর্ঘতম আলাপ বিলকিস আজ সেরে নিয়েছে। যার জন্যই হয়তো এতোদিন সে প্রতীক্ষা করেছে। যার জন্য হয়তো আরও অনন্ত কাল প্রতীক্ষা করতে পারবে। ফারহান তার বাড়িতে বিলকিসের কথা বলেছে। এখন দেখতে আসার কথা।  

সব ঠিকঠাকই চলছিল। বিলকিসের পক্ষ থেকে ফারহানদের বাসায় দেখে এসেছে। আর একদিন পরই ফারহানের পক্ষ থেকে বিলকিসকে দেখতে আসবে। ফারহানের যে চাচার মাধ্যমে বিয়ের কথা আগাচ্ছিল, কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন বিলকিসকে দেখার দিনই আকদ করে ফেলবেন তারা। সে ভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিলকিসের পরিবার। কাছের আত্মীয়-স্বজনকে বলা হয়েছে। অকস্মাৎ ঘটনাটা ঘটলো। জানা গেলো, ফারহান আসছে না। এই নিয়ে চাপা গুঞ্জন বইতে লাগলো বিলকিসের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে। বিলকিস ফোন করে আকদ হওয়ার কথা ফারহানকে জানাতেই, ফারহানের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ার যোগাড়। আকদের কথা আসছে কোত্থেকে! ‘আজ তো কনে দেখতে যাওয়ার কথা। অফিসিয়াল ট্যুরে সিলেট যাচ্ছি আমি। আমার আসার প্রশ্নই আসে না। বিলকিস বুঝিয়েছিল, দেখ ফারহার যে ভাবেই হোক ভুল বোঝাবোঝিতে আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা জেনে গেছে কাল আকদ হচ্ছে। এখন যদি আকদ না হয়, অন্তত তুমি না আস তবে আমি কিছুতেই সামলাতে পারবো না, প্লিজ তুমি একটু ভেবে দেখ। কিন্তু ফারহান কিছুই বুঝতে চেষ্টা করলো না। ’ ফারহান বলে দিয়েছে, এই মুহূর্তে কোনোভাবেই তার পরিবারকে বোঝানো সম্ভব নয় যে কাল তাদের আকদ হতে যাচ্ছে। তাদেরও একটা সামাজিক অবস্থান আছে। এই মুহূর্তে আকদের কথা কিছুতেই ওঠানো সম্ভব নয়। এ বিষয় নিয়ে আর ফোন না করতে কড়াভাবে বলে দিলো ফারহান। ফারহানের কথায় অপমানিত হয়ে বিলকিস বেঁকে বসলো। কোনোভাবেই আর ফারহানকে বিয়ে করতে রাজি হলো না। এতোদিনের অপেক্ষা, এতোদিনের স্বপ্ন সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো— অনেক হয়েছে আর না। যে ছেলে এমন একটা বিপদের সময় তার পাশে দাঁড়ালো না, তার সঙ্গে সারা জীবন কাটানোর প্রশ্নই আসে না। নদীর প্রচণ্ড স্রোত যেমন বাঁধ ভেঙে সবকিছু তলিয়ে দিয়ে যায়, উপরে টলটলে জলের উপস্থিতি টের পেতে দেয় না যে একসময় বাঁধ ছিলো সেখানে, তেমনি বিলকিসের মনেও যে ফারহানের অস্তিত ছিলো সেটা আর টের পাওয়া গেলো না। ফারহানদের বাসায় জানিয়ে দেওয়া হলো আগামীকালের কনে দেখার প্রোগ্রামে তারা আর রাজি নয়। বিলকিস আসলে প্রচণ্ড মাত্রায় জেদী ও আত্মম্ভরী স্বভাবের একজন মানুষ। যে নিজের মতের উপর কারও মতের প্রাধান্য কখনও সহ্য করতে পারে না। সবসময় নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কখনও অন্যের কাছে নিজেকে ছোট দেখতে চায় না। অন্যের মতামত মেনে নেওয়াকে নিজের হেরে যাওয়া ভাবে। তাই এখনও ফারহানের কাছে হারবে না বলেই বিয়েতে আর রাজি হলো না। সবাই চাইছিল ফারহানরা একবার আসুক, তারপর ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। কিন্তু কারও কথাই বিলকিস শুনলো না।  

বিলকিস নতুন চাকরিতে যোগদান করেছে। মাসখানেক পর ফারহান একবার এসেছিল। স্কলারশিপ নিয়ে সে কানাডাতে মেডিসিনাল কেমিস্ট্রিতে পড়াশুনা করতে যাচ্ছে। পরিবার থেকে আবার বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিলকিস আর কিছুতেই রাজি নয়। অবশেষে ফারহান তাদেরই আরেক বন্ধু শায়লা নূরকে বিয়ে করে কানাডায় চলে গেছে। কিন্তু বিলকিস আর সে পথ মাড়ায়নি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফারহান ভালোই আছে। মেয়ের নাম রেখেছে ফারি। বিলিকিসের তেমনটিই ইচ্ছে ছিলো। প্রথম মেয়ে হবে আর ফারহানের নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখবে ফারি। পিএইডি শেষে উনিভার্সিটি অব নিউ ব্রান্সউইকের মেডিসিনাল কেমিস্ট্রির নাম করা প্রফেসর সে এখন। গবেষণায় দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি। বিশ্ব ঘুরে বেড়ায় গবেষণা কর্ম নিয়ে।

বিলকিসের একটা সম্পর্ক হয়েছিল বছর দুই আগে। বয়সে তের বছরের ছোট আবরারের সঙ্গে। ফেসবুকে পরিচয়। তারপর জানা-শোনা, কাছে আসা। সেটাও সংসারী করেনি বিলকিসকে। আসলে বিলকিস এখন আর সংসারে মনযোগী নয়। সংসারে মন দেওয়া আর তার দ্বারা হবে না। আবরার বিয়ের জন্য বেশ চাপ দিচ্ছিল। আবরার বলেছিল, সামাজিক যেকোনো চাপ সে সামলে নেবে, বিলকিস যেনো মন খারাপ না করে। বিলকিস আবরারকে বলেছিল, আবরার তোমার যতো ভালবাসা চাও আমি সব উজাড় করে দেবো। কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে বলো না। বিয়ে যদি তোমার করতেই হয়ে তবে দেখে-শুনে একটা করে নাও। আমি তোমাকে ফেরাবো না। আবরার যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। তারপর নিজে থেকেই দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছে। গত বছর সেও বিয়ে করেছে। বিলকিস নিজেই এখন আর কোনো খবর রাখে না তার।
 
সেই যে চাকরি নিয়ে বাবা-মা থেকে আলাদা থাকছে, আর ফিরে যায়নি। সপ্তাহে-মাসে একবার করে ঘুরে আসে। মা-বাবাও ঘুরে যান সময় করে। এমন বৃষ্টিস্নাত আয়েশি বিকেলে ইদানিং শুধু শুধু মন খারাপ হয় বিলকিসের। কেমন যেন শূন্য লাগে। এককীত্বের বোধ থেকে ইদানিং নতুন ভূত চেপেছে বিলকিসের মাথায়। মা হতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু কোনো পুরুষকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। তার সন্তান বেড়ে উঠবে শুধু তার পরিচয়ে। নিজের মতো করে গড়ে তুলবে তাকে। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখেছে বিলকিস। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ডাক্তার টেস্টটিউব বেবি নিয়ে গবেষণা করছে। তারা ভলান্টিয়ার খুঁজছে, যারা নিজেদের গর্ভে সন্তান নিয়ে গবেষণায় সহযোগিতা করবে।

গেলো সপ্তাহে বিলকিস গবেষক দলের প্রধান ডা. প্রলাকা সেনের সঙ্গে দেখা করে এসেছে। ডাক্তার জানিয়েছে, সিমেন ভলান্টিয়ার কার্যক্রমের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে, কিছু সিমেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা হবে। বিলকিসের আগ্রহ দেখে ডা. প্রলাকা সেন বেশ উৎফুল্ল। বলেছেন, আপনাদের মতো সচেতন মানুষ যদি গবেষণায় সহায়তা করেন তবে আমরা গবেষণায় অনেক দূর এগুতে পারবো। বিলকিস তার দু’টি শর্ত জুড়ে দিয়ে এসেছে, গর্ভধারণ সম্বন্ধীয় যেকোনো সমস্যায় তাকে সাহায়তা করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে সে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, কেউ কোনোদিন তার সন্তানের পিতৃত্ব দাবি করবে না। সন্তান বড় হবে শুধু তার পরিচয়ে। ডা. সেন তাকে আশ্বস্ত করেছে এবং নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছে। প্রয়োজনে তাকে দেশের কোনো সিমেনই দেওয়া হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যক্রমে যে সিমেন সংগ্রহ করা হবে সেই শুক্রাণুতে তার গর্ভধারণ হবে।

অফিস থেকে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছে বিলকিস। শুরুতে ছুটি নিয়ে অফিস বেশ ঝামেলা করেছিল, যেহেতু তার বৈবাহিক অবস্থা অফিসের কাছে অবিবাহিত হিসেবেই নথিভুক্ত ছিলো। তবে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মের ভলান্টিয়ার হিসেবে ঝামেলামুক্তভাবেই ছুটি পেয়েছে বিলকিস। মা হিসেবে তার ভিতরে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। একটা সন্তানের মা হতে চলছে, ভাবতেই অদ্ভুত একটা সুখানুভূতি তাকে ঘিরে রাখছে। তখন সব দুঃখ ভুলে যায় বিলকিস। জীবনের না পাওয়াগুলো, অপূর্ণতাগুলো সব চাপা পড়ে যায় পেটে হাত বুলাতে বুলাতে। মা বেশির ভাগ সময়ই এখন বিলকিসের কাছে এসে থাকেন। গৃহপরিচারিকা শায়লা এবং গবেষণা দলের পক্ষ থেকে একজন সেবিকা সবসময় বিলকিসের খেয়াল রাখছেন। আট মাসের মাঝামাঝি চলছে। এখন সন্তানের অস্তিত্ব পুরোপুরিভাবে বোঝা যায়। প্রতিনিয়ত সন্তানের নড়াচড়া বিলকিসকে ব্যস্ত রাখে। গত মাসে অস্বস্তি লাগছিল বিলকিসের। সন্তানের নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছিল না। ডা. প্রলাকা বলেছিল ভয়ের কিছু নেই, তবুও সিঙ্গাপুর গিয়ে একবার চেক আপ করিয়ে এসেছে। তবে ডা. প্রলাকা সঙ্গে গিয়েছিল।  

সন্ধ্যায় ডা. প্রলাকার ফোনে বিলকিসের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এতোদিনের সব আবেগ-অনুভূতি, সুখানুভব, অনাগত সন্তানকে নিয়ে সাজানো স্বপ্ন সব উলট-পালট হয়ে গেলো। বিলকিস স্থির করলো সে সন্তানকে আর পৃথিবীর মুখ দেখাবে না। সন্ধ্যা থেকে অনেকবার ভেবেছে। কীভাবে সন্তানকে পৃথিবীতে আসার আগেই মৃত্যু নিশ্চিত করা যায়। রাত দুইটা পঁয়তাল্লিশ। অনেক ভেবেছে। সন্তানের প্রতি মায়া জন্মে গেছে। কিছুতেই অ্যাবরশন করে নিজে বেঁচে থাকতে পারবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলো নিজেই আত্মহত্যা করবে। তিনটা বেজে ঊনষাট মিনিট। কিছুতেই আর দেরি করা যায় না। ড্রিম লাইটের আলোয় নিজেকে একবার দেখে নিলো আয়নায়। ডাইনির মতো লাগছে। যে ডাইনী নিজের ভিতরের একটা ভ্রুনকে হত্যা করতে অপারগ হওয়ায় নিজেকেই শেষ করতে যাচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে টুলটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে সিনিং ফ্যানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফ্যানের সঙ্গে শাড়ি পেঁচিয়ে এবার নিজের গলায় শক্ত করে বেঁধে নিলো। শেষবারের মতো পেটে হাত বুলিয়ে চোখ দিয়ে জলের ফোয়ারা বইয়ে দিলো। মনে মনে আওড়ে যাচ্ছে, হে আমার প্রিয় সন্তান শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি তোমায় পৃথিবীর আলো দেখাতাম। নিন্দুকের বাঁকা চোখ থেকে আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সেই ভ্রূণ যদি না ফারহানের হতো। যে তোমার মায়ের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যে আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আমার স্বপ্ন, আমার সাধ, আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছে। তার সন্তানের মা হতে আমি চাই না। আমায় ক্ষমা করো হে আমার প্রিয় সন্তান।  

ডা. প্রলাকা জানিয়েছে, আগামী মাসের সিজার করা হবে। শুক্রাণু দাতা কানাড়ার বিখ্যাত গবেষক ড. ফারহান হায়দার তার সন্তানকে দেখতে আগামী মাসে আসবেন। আমরা খুবই দুঃখিত আপনার দ্বিতীয় শর্তটা আমরা রাখতে পারিনি। তবে সবকিছুই আমাদের ইচ্ছের বাইরে হয়েছে। আমরা জানতাম না শুক্রাণুদাতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এবং তিনি ভবিষ্যতে সন্তান দেখতে চাইবেন। উই আর রিয়েলি সরি ম্যাডাম।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিলকিস দেখে নিলো চারটা বত্রিশ। আর দেরি করা যায় না। মানসিকভাবে হয়তো দুর্বল হয়ে যাবে। শেষে আর আত্মহত্যা করা হবে না। বিলকিস হারবে না। গলায় শাড়ির গিঁটটা আর একবার পরখ করে নিয়ে পা দিয়ে টুলটা ধাক্কা দিলো। চোখ বন্ধ করে আছে। দমটা আপনা আপনিই আটকে আসছে বিলকিসের। অবর্ণনীয় কষ্ট হচ্ছে সন্তানসহ নিজেকে শেষ করে দিতে। অনাগত সন্তানের কল্পিত মুখ সামনে এনে দুঃখবোধটা আরও বেড়ে গেলো। পৃথিবীর কোনোকিছুই হয়তো সন্তানের ভালবাসার কাছে যথেষ্ট না। বিলকিসের বেঁচে ফিরে আসার ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে খুব, কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। হঠাৎ করেই হালকা লাগলো। শেষ মুহূর্তে পা দিয়ে টুলের পতন ঠেকালো বিলকিস। গলায় শাড়িটা ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ততোক্ষনে সেবিকা এসে পড়েছে।

শরতের তুলতুলে সকাল। ব্যালকনিতে রোদ এসে পড়ছে। লেকের পানিতেও খেলা করছে রোদ। দূরে আকাশে মেঘ অযথা অকর্মণ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সব ভালোবেসে বিলকিসের মনে হচ্ছে পৃথিবীটা বেঁচে থাকার জন্য খারাপ না। এইসব ছোটখাটো অনুসঙ্গ আর ভালোলাগাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। সে রাতের ঘটনার পর সবাই আরও সচেতন হয়েছে তার ব্যাপারে। নিয়মিত একজন সাইক্রিয়াট্রিস্ট এসে কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কাটিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে শুয়ে আছে বিলকিস। পাশে কাঁচে ঘেরা অবস্থায় শুয়ে আছে তার ছেলে। ডাক্তাদের বড় একটা টিম কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সিজার করেছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, সময়ের আগে সিজার করবে কিনা। সময়ের আগেই সিজার করা হয়েছে। মা-ছেলে দু’জনেই এখন ভালো আছে। বিলকিসের কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো বিলকিস। সেদিন ভাগ্য তার সহায় ছিলো। শেষ মুহূর্তে সন্তানের কল্পিত নিষ্পাপ মুখ চোখে ভেসে ওঠায় আর মরতে পারেনি। আজ সন্তানের মুখ দেখে আর আফসোস হচ্ছে না। ফারহানের ফটোরকপি। নাক, চোখ, মুখাবয়ব সব। যাকে দূরে ঠেলেছে, সেই দোর ঠেলে বিলকিসের ঘরে এসেছে। বাঁধভাঙা পানি যেমন সামনে যা কিছু পায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি ফারহানের সব স্মৃতি কোথা থেকে যেনো মনের মধ্যে ঢুকে গেলো। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো বিলকিস। এই কান্না কী না পাওয়ার, হারানোর, নাকি সব হারিয়ে কিছু পাওয়ার, তা কে বলবে? মাতৃত্ব সব না পাওয়াকে বোধ হয় পূর্ণতা দিয়েছে। সেসবের হিসাব এখন আর মেলাতে চায় না বিলকিস। সন্তানই এখন তার পৃথিবী। ফারহান ফিরে এসে সন্তান দেখতে চাইলে, পিতৃত্ব দাবি করলে কী বলবে, সেসব আর এখন ভাবনায় নেই বিলকিসের।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ