ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বাংলাদেশের বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে দুটি কথা

পি.আর.প্ল্যাসিড, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৩ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১২
বাংলাদেশের বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে দুটি কথা

হঠাৎ করেই বাংলানিউজটোয়েন্টি ফোরের প্রেমে পড়লাম মনে হচ্ছে। চোখ খুলেই নেটে দেখি বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর, আবার চোখ বন্ধ করার আগেও একবার দেখি বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর।

এই জনপ্রিয় সাইটটিতে সম্প্রতি উঠে এসেছে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের গাফলতির কারণে বাংলাদেশের একটি হাসপাতালে সাতমাসের অন্ত:সত্ত্বা এক মহিলার মৃত্যুসংবাদ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর মেয়ের বাবা বাদী হয়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিলেও আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। সংবাদটি পড়ার একটু পরেই ফেইসবুকে দেখলাম হাসপাতালের কিছু অনিয়মের সংবাদ। ইটিভির ক্যামেরায় ধারণকৃত টিভি সংবাদ-এর ফুটেজ ফেইসবুক বন্ধুরা আপ করে দেওয়ার পর অনেকে শেয়ার করার কারণে চোখের সামনে ভেসে এলো। একটার পর একটা নিউজ। ঢাকা মেডিকেলে দেখা গেল ডাক্তার নেই অথচ ব্রাদার-বয়-সুইপাররা কিভাবে ডাক্তার বনে যায়, আর পংগু হাসপাতালে কিভাবে ভাংগা পায়ের বদলে ভাল পায়ের চিকিৎসা করেছে।

আমরা দেশের বাইরে বসে এভাবেই দেশের পরিস্থিতি জানার সুযোগ পাই। অনলাইন নিউজপেপার কিম্বা আধুনিক সোসাল সাইট ফেইসবুকের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার ছবিসহ সংবাদ এবং চলমান চিত্র দেখার সুযোগ হয়। এসবের কোনোটাই অবিশ্বাস্য বা বানোয়াট নয়। বিভিন্ন মিডিয়াকর্মী বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাও ফেইসবুকের মাধ্যমে তাদের কলমে বা ক্যামেরায় তুলে আনা সমাজের বিভিন্ন ঘটনা তুলে এনে প্রচার আর প্রসার ঘটাচ্ছেন এই ফেইসবুকের মাধ্যমে। কিছু ঘটনা মিথ্যা বা বানোয়াট হতে পারে, এই বলে সব যে মিথ্যা আর বানোয়াট তা হতে পারে না। আমি অন্তত এমন কথা মানতে নারাজ।
 
সম্প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একজন উর্ধ্বতন ব্যক্তি ফেইসবুকের কোনো কিছু বিশ্বাস করতে মানা করেছেন। আমি মনে করি বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে, পৃথিবীর এতবড় সফল একটা সামাজিক সাইটকে দেশের এতবড় গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি না দেখার বা বিশ্বাস না করার কথা বলে নেহায়েৎই নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি যে সত্য আর বাস্তবতাকে অবহেলা করলেন তারই প্রমাণ এই অজ্ঞতাপূর্ণ কথায় প্রকাশ পেল। প্রধানমন্ত্রী যেখানে ২০২১ সনের লক্ষ্য অর্জনের কথা বলে দেশকে ডিজিটাল করার পরিকল্পনায় বিভোর, সেখানে তারই কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এমন কথা বলেন কি করে বুঝে উঠতে পারছি  না।

বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলে শেষ করা যাবে না। জাপানপ্রবাসী এক যুবক দেশে বিয়ে করেছেন, নাম তার তোতা মিয়া ঢালী। বাড়ী শরীয়তপুর। গত বছরের শুরুতে তার ছেলে সন্তান হয়েছিল এক হাসপাতালে ডাক্তারদের সহায়তায়। সেখানে ভুল চিকিৎসার ফলে বাচ্চাটি হবার কয়েকদিন পর মারা যায়। তোতা মিয়ার মুখেই শুনেছি, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের এই ভুলের জন্য কিছু টাকা দিতে চাইলেও সেই প্রবাসী নাকি বলেছিলেন, টাকা দিয়ে কি হবে, আমার সন্তানতো আর ফিরে আসবে না! সেবার মিডিয়ার কাছে বিষয়টি ইচ্ছা করেই বলেননি। এবছর আবার ছেলে সন্তান হয়েছে ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালে। এখানেও নাকি আবার এক বিশাল ঝামেলা হয়েছে বলে তোতা মিয়া জানিয়েছেন। সবই ভুল চিকিৎসার কারণে। অনেক কিছুর পর এখন বাচ্চা ও বাচ্চার মা সুস্থ।

গত বছর আমি দেশে গিয়ে জানতে পারলাম আমার এক আত্মীয় ভুল চিকিৎসার কারণে বেশ কিছুদিন পঙ্গু অবস্থায় বিছানাতে পড়ে থেকে শেষ পর্যন্ত গতবছর মারা যান। এর আগে পত্রিকাতে পড়েছি, একপায়ের সমস্যায় আরেক পা কেটে ফেলেছে ভুল করে। এজন্য নাকি পরে ডাক্তার ক্ষমাও চেয়েছে। এমন অনেক ঘটনাই ঘটে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে হাসপাতাল আর ক্লিনিকগুলোতে যা আমরা জানি না। এতো গেল অন্যর কথা।
গত বছর আমি ধানমণ্ডির এক হাসপাতালে কিছুদিনের জন্য ভর্তি হলাম। আমার অবস্থা তখন অতি স্বাভাবিক মনে করে আমার আট বছর বয়সের ছেলে থাইওকে সাথী করে সকালে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। ভর্তির ঘণ্টাখানেক পরেই আমাকে ওটিতে নিয়ে পিছন দিকে (পিঠের শিরদাঁড়ায়) ইনজেকশন দিয়ে কোমর থেকে নীচের অংশ অবশ করা হল। নীচের অংশ অবশ করা হলেও আমি সব কথাই শুনছি আর দেখছি। পেটের উপর একটা পর্দা ঝুলিয়ে নীচের দিকে কাটাকাটির বিষয়টি আমাকে না দেখার মত ব্যবস্থা করল। উপস্থিত সকলেই বলাবলি করছিল, আমার পেট কাটা হবে, এপেনডিসাইটিসের অপারেশন করতে। আমি তো শুনে অবাক। খেপে গেলাম আমি। বললাম প্রধান ডাক্তারকে ডাকতে। সময় হলে প্রধান ডাক্তার এলেন, এসে দেখেন যন্ত্রপাতিও আনা হয়েছে ভিন্ন। সঙ্গে সঙ্গে বলা হল বদলাতে। আমার সেই সময়কার অবস্থার কথা মনে হলে দেশের ডাক্তারদের প্রতি দায়িত্বহীনতার কারণে আর সম্মানবোধ জাগে না। মনে হয়েছিল আমি উঠে সবকটাকে-----!!
 
জাপান ফিরে আসার তারিখ ঘনিয়ে আসার কারণে এক সপ্তাহের মত হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর একপ্রকার জোর করে রিলিজ নিয়ে বের হয়ে আসি। ডাক্তার চাচ্ছিলেন আরও কিছু দিন থাকি। থাকলেইতো টাকা। ওটির কথা মনে করে সেখানে আমি একদিনও থাকতে চাইনি যদিও, ডাক্তারের কথা অমান্য করলে আবার ভুল ঔষধ দিয়ে দিলে অবস্থা হবে আরও খারাপ। এই মনে করে কিছুদিন ছিলাম।

সেদিন যিনি আমার মূল চিকিৎসক ছিলেন, তার কাছ থেকে একদিন একটা মেইল পেলাম। মেইলে লিখেছেন তিনি জাপান আসবেন। একদিন আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আমি যেন সময় দেই। আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা করেছেন এই কথা জেনে খুশ হলাম। ভাবলাম আমার চিকিৎসক জাপানে আসছেন, জাপান এলে তাঁকে বলার সুযোগ হবে দেশের এই চিকিৎসাক্ষেত্রের অনিয়মের কথা। সময়মত ডাক্তার সস্ত্রীক এলেন একটা সম্মেলনে যোগ দিতে।

জাপান আসার পরেই জানলাম ডাক্তারের সুখ্যাতির কথা। তিনি যে বাংলাদেশে অনেক পরিচিত একজন তা আমি দেশে থাকা বা তাঁর চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও জানতাম না। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ডাক্তার এটাও জানা ছিল না। তাদের আরও একটি বড় পরিচয় আছে, ডাক্তারের শ্যালক বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক। ডাক্তারদ্বয় জাপানে সম্মেলন শেষে একদিন আমার সঙ্গে ছিলেন। তখনই আমি আমার সেই ভূল চিকিৎসার কথা আবার স্মরণ করিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার এই দুরাবস্থার কথা বললাম। তিনি দেশে তাঁর আরও অনেক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন, কিন্তু এসব ভুল ঠিক করার মানসিকতা এখনও যে আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি সেই কথাও।
 
জাপানেও এমন ভুল চিকিৎসা যে হয় না তা নয়, হয় তবে অনেক কম, বাংলাদেশের মত এমন কঠিন অবস্থার কথা এখন পর্যন্ত শুনিনি। জাপানে নার্সদের বিশেষ ট্রেনিং থাকে, করলে তারা কিছু একটা করে হয়তো। ব্রাদার বা বয় এরা কখনও অপারেশন থিয়েটারেই যায় না। ডান পায়ের বদলে বাম পায়ের অপারেশন এমন ঘটনা বিগত বিশ বছরের জাপানে প্রবাস জীবনে পাইনি।

এপর্যন্ত জাপানে আমি দু’বার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। প্রথম ১৯৯১ সনে টোকিওর ওৎসকা কেনসার হাসপাতাল। তখন আমি জাপানি ভাষার কিছুই বুঝতাম না। আমার সাথে কথা বলার জন্য স্পেশাল ইংরেজি জানা ওয়ালা ডাক্তার আর নার্স সংগ্রহ করে আনা হয়। আমার মন খারাপ হলে কত কি যে করা হত মন ভাল রাখার জন্য।

এরপর জাপানে ঘটে যাওয়া দাই সিনছাই বা সবচেয়ে বড় প্রাকৃকিত যে দুর্ঘটনা ‘সুনামী’ হয়ে গেল, এই সুনামি হয়ে যাবার কিছুদিন পর সেই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে এসে অসুস্থ হযে পরলাম। এরপর হসপিটালে ভর্তি হতে হল আমাকে। প্রথমে ডাক্তার আমার দুই পায়ের অবস্থা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, পা কাটতে হতে পারে। ডাক্তারের কথা শুনেই দেশে আমার এক পরিচিত মিশনারি (পুরোহিত) ফাদার কমল ডি কস্তার কথা মনে পড়ল। পায়ের আংগুল কাটার মধ্য দিয়ে শুরু করে পা কাটতে হল। পরবর্তীতে পা এর কারণে মারাই গেলেন তিনি। শুধু তাই নয়, এইতো কিছুদিন আগে আমার আরেক পরিচিতজন, হোটেল রেডিসনে কর্মরত তার পায়ে গোটা হয়েছিল, এজন্য পায়োর আংগুল ফেলে দিতে হল তাকে। এসব বলার কারণ, আমার দু’পাই এখন ভাল, কাটতে হয়নি। আর বাংলাদেশে পায়ের জন্য জীবন পর্যন্ত গেছে। জাপান-বাংলাদেশ দুই দেশেই কিন্তু একই চিকিৎসাশাস্ত্র ফলো করা হয়, দুই দেশে একই বিজ্ঞান প্রযুক্তি। কেবল প্রয়োগের আন্তরিকতার অভাবে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে আমাদের দেশে।  

বাংলাদেশে বিশাল বিশাল হাসপাতাল গড়ে উঠছে। এদের উদ্দেশ্যই ব্যবসা। দেশের রোগীরা যেন দেশের টাকা দেশের বাইরে গিয়ে খরচ না করেন এজন্যই নাকি দেশে এইসব হাসপাতাল গড়ে তোলা। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, এদের উদ্দেশ্য ব্যবসা, সেবা নয়। সুতরাং রোগীর সেবা করবে কিভাবে ডাক্তারগণ। তারাতো চাইবেনই, বয় ব্রাদার আর নাইটগার্ড দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করিয়ে নিজেরা রিলাক্স করবেন বা বেশি উপার্জনের ধান্ধা করবেন।
এপর্যন্ত বেশ কিছু সংস্থা আমার সঙ্গে আলোচনা করেছে বাংলাদেশে এইখাতে কাজ করার জন্য। কিন্তু আমি আলোচনা শুনে ভয়ে আর এগুতে পারলাম না। কারণ আমার যা কাজ নয়, সেই বিষয়ে কথা বলতে গেলে নিশ্চিত বিপদ।

সম্প্রতি একটি ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের কর্মকর্তা আমাকে ডেকে তাদের ইচ্ছার কথা বললেন। দেশে তারা তাদের ব্রাঞ্চ করতে চান। আমি বললাম, হাসপাতাল করা সহজ, জাপান থেকে যন্ত্রপাতি সবই নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু হাসপাতালের সব ডাক্তার আর ম্যানেজমেন্টের লোকতো আর জাপানিজ নিয়ে পারবে না। সুতরাং নির্ঘাৎ সেই হাসপাতালের যন্ত্রপাতি দেখা যাবে ধোলাই খাল বা অন্য কোনো মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে, এটাই হবে বাস্তবতা।

দেশের ডাক্তাররা যতদিন সাদা গাউন পরে মনে না করবেন,  এটা তাঁদের সেবার প্রতীক ততদিন দেশের মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হবেই। রেডক্রসকে ভাগ করে রেড ক্রিসেন্ট করা যায়, সেবার মান আর ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সততার সঙ্গে কিন্তু রোগীর সেবা করা যায় না।  

সুতরাং বাংলাদেশের বর্তমান বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চাই উন্নত মন। ডাক্তার আর সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতাই পারে এর সমাধান দিতে।

লেখক: জাপানপ্রবাসী সাংবাদিক।
[email protected]

বাংলাদেশ সময় ২০২০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১২
এমএমকে/ সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।