ঢাকা: সুরুজ মিয়ার বয়স এখন পঁচাত্তর। বয়সের ভার তার কম নয়।
হসপিটালে ছিলেন পুরো দু’দিন। কিন্তু সুচিকিৎসা তো দূরের কথা, বাড়তি হিসেবে পেয়েছেন শ্বাসকষ্টের অতিরিক্ত যন্ত্রণা আর ডাক্তারদের সৃষ্টি করা নানা বিড়ম্বনা!
সুরুজ মিয়ার যন্ত্রণা বাড়লে চিকিৎসা দেওয়ার আগে রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বন্ডে সই করতে বলেন। পাশাপাশি তাদের ৬ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে জানায়, এর মধ্যে রোগী যেকোনো সময় স্ট্রোক করতে পারেন।
হাসপাতালের এহেন অবস্থা ও শর্ত দেখে রোগীর পরিবার রোগীকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করে সুচিকিৎসা নেয়। এখন সুরুজ মিয়া অনেক ভালো আছেন। প্রবীণ হাসাপাতালের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে স্ট্রোক করা তো দূরের কথা, একদিন না পেরুতেই তিনি লাঠি ভর করে গলির এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে সুরুজ মিয়ার ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ওরা (প্রবীণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ) বলেছিলো আমার বাবা ৬ ঘণ্টার মধ্যে স্ট্রোক করে মারা যাবেন। কিন্তু অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন আমার বাবা সুস্থ। ভালোমতো খাবার খেতে পারছেন। সঙ্গে সঙ্গে চলাফেরাও করতে পারছেন স্বাভাবিকভাবে।
তিনি বলেন, প্রবীণ হাসপাতালে কিছুই নেই। তাদের রিপোর্ট আর বাইরের রিপোর্টের সঙ্গে কোনো মিল নেই। নেই ভালোমানের কোনো ডাক্তারও। যারা আছেন তাদের সঙ্গে হাতুড়ে ডাক্তারে কোনো পার্থক্য নেই। এখানে প্রবীণরা চিকিৎসা তো পান-ই না, বরং বৃদ্ধ বয়সে ভাগ্যে জোটে অতিরিক্ত আতঙ্ক।
শুধু সুরুজ মিয়া নন, সুরুজ মিয়ার মতো আরও অনেক প্রবীণ ভুল চিকিৎসা পেয়ে থাকেন প্রবীণ হাসপাতালে।
তাদের মধ্যে আরেকজন আব্দুল খালেক মোল্লা। জন্মস্থান গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। বছরখানেক আগে তিনি প্রবীণ হাসাপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিলো তার দু’টি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। সঙ্গে লিভারও। কয়েক মাস আতঙ্কে কেটেছে খালেকের। তবে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন তিনি দিব্যি সুস্থ।
এ বিষয়ে খালেকের বড় ছেলে আবুল খায়ের বাংলানিউজকে বলেন, হাসপাতাল থেকে জানানো হয় বাবার দু’টি কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে আমার বাবা সুস্থ আছেন। রক্ত শূন্যতা ছিল সেটাও এখন সেরে গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সব কিছুর দশাই বেহাল। প্রবীণদের চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা নেই।
এর কিছু কারণ বাংলানিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
মান্ধাতার আমলের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি
এখানে পুরনো ও নষ্ট যন্ত্রপাতি দিয়ে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কার্ডিওলজি, ফিজিওথেরাপি, প্যাথলজি বিভাগসহ এক্সরে, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইকো-কার্ডিওগ্রাম ইত্যাদি পরীক্ষা- নিরীক্ষার অধিকাংশ যন্ত্রপাতিগুলো পুরনো।
যে কারণে অনেক রোগী এখান থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে অধিকাংশ সময় সুরুজ মিয়া ও আব্দুল খালেকের মতো ভুল রিপোর্ট পান।
অদক্ষ চিকিৎসক, তবুও অপ্রতুল
প্রবীণ হাসপাতালে দক্ষ কোনো চিকিৎসক নেই। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হচ্ছেন এমবিবিএস। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ও ৬তলা বিশিষ্ট প্রবীণ নিবাস চলে মাত্র ২০ জন চিকিৎসক দিয়ে। প্রতি শিফটে থাকেন মাত্র তিনজন চিকিৎসক। এসময় আন্তঃবিভাগ, বহির্বিভাগ এবং প্রবীণ নিবাস চলে মাত্র তিনজন ডাক্তার দিয়েই।
২৪ ঘণ্টা ফার্মেসি সাপোর্ট ও পরীক্ষ-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই
দুপুর আড়াইটার পর ফার্মেসি বন্ধ হয়ে যায়। জনবলের অভাবে তিনটার পর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকে না। এর ফলে মুমূর্ষু রোগীরা দুপুরের পর ভর্তি হতে পারেন না। প্রয়োজনে কিনতে পারে না ওষুধও।
একজন ভুক্তভোগী শরিফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রাতে অনেক সময় বাবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ লাগে। কিন্তু এর জন্য শাহবাগ অথবা কলাবাগান দৌঁড়াতে হয়।
পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স সাপোর্ট নেই
৫০ শয্যা হাসপাতাল চলে মাত্র দু’টি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে। প্রয়োজন মোতাবেক অ্যাম্বুলেন্স পায় না রোগীরা। অ্যাম্বুলেন্স অনেক সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে। ইচ্ছা করলেই কর্তব্যরত চিকিৎসক এগুলো রোগীদের জন্য ব্যবহার করতে পারেন না।
প্রবীণ নয়, চিকিৎসা দেওয়া হয় নবীনদের:
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রাচীনতম ও বৃহৎ একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যা মূলত প্রবীণদের সেবায় নিয়োজিত থাকার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রবীণদের চিকিৎসা দেওয়ার বদলে যেন নবীনদের চিকিৎসা দিতেই বেশি ব্যস্ত।
এখন হাসপাতালটি মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য থেকে সরে এসেছে। এখানে নারী, শিশু, পুরুষসহ সব ধরনেরর চিকিৎসা দিচ্ছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকার আগারগাঁওয়ে প্রায় এক একর জমির উপর নির্মিতি একটি চারতলা ও ছয়তলা ভবনসহ দেশের ৭টি বিভাগ এবং ৫৪টি জেলা শাখায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব শাখায়ই রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ এস এম আতিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রবীণদের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। তাদের চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণে অর্থ দরকার তা নেই। যে কারণে ভালো মানের চিকিৎসক নেই।
তিনি বলেন, একজন ভালোমানের চিকিৎসক রাখতে হলে মাসিক দেড় থেকে দুই লাখ টাকা বেতন দিতে হবে। কিন্তু মাসিক ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতন দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।
ডা. আতিকুর রহমান বলেন, টাকার অভাবে আমরা ভালো যন্ত্রপাতিও কিনতে পারিনি। প্রবীণদের জন্য ভালো ফ্যাসিলিটিও নেই।
তিনি আরও বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রবীণ হাসপাতালের কাঠামো তৈরি করলেও তা ঠিকমতো বাস্তবায়িত দিচ্ছে না। এখন আমরা সরকারি তহবিল থেমে বাৎসরিক দুই কোটি টাকা পাচ্ছি। যে কারণে প্রবীণদের মানসম্মত চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি।
হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা একে এম আব্দুল ওয়াহীদ যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি জর্জরিত হয়ে তা ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০১৩/আপডেট ১১৩৫ ঘণ্টা
এমআইএস/এএ/এমজেএফ/আরকে/জেএম