ঢাকা: রাজধানীর বুকে ১২তলা বিশিষ্ট ভবনে একটি বিশাল হাসপাতাল। মূল ফটক থেকে প্রায় দুশো মিটার ভেতরে হাসপাতাল ভবন।
বিমানবন্দরের দিকে যেতে নতুন নির্মিত ফ্লাইওভার দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে ‘কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল’ লেখা বিশাল নামফলক। নামেই পরিচয়, এটি সাধারণ মানুষের একটি হাসপাতাল। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে এখনো সাধারণের হয়ে উঠতে পারেনি।
২০১২ সালের ১৩ মে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর উত্তরাঞ্চলের নাগরিকদের চিকিৎসা সেবা সহজতর ও হাতের নাগালে নিয়ে যেতে বেশ জাকজমকপূর্ণ ছিলো এই উদ্বোধন। ২২৬ কোটি টাকা সরকারি অর্থব্যয়ে ২০১০ সাল থেকে শুরু হয় এ ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালের নির্মাণ কাজ। উদ্বোধনের পর এক বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও এখনো প্রাণ পায়নি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা।
ঈদের পর গত রোববার ছিল প্রথম কর্মদিবস। সন্ধ্যায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যেয়ে মনে হলো এটি ভুতের বাড়ি। হাসপাতালের মূল ফটক খোলা ছোট করে। ভেতরে ঢুকে হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া একটি জনমানবও চোখে পড়লো না।
এর আগে গত ৯ অক্টোবর, বুধবার বেলা একটায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা গুটিকয় মানুষ আউটডোরে জরুরি সেবা নিচ্ছেন। ইনডোরে গুনে দেখা গেলো রোগী ভর্তি আছেন মাত্র ১৬ জন।
তবে এই রোগীরাও এখনো কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে পূর্ণাঙ্গ সেবা পেতে শরু করেননি। রোগীদের রেফার করা হচ্ছে অন্য হাসপাতালে। যার প্রমাণ মিললো রোগী বা তাদের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে।
আট বছর বয়সী স্বপ্নিলের কয়েকদিন ধরে জ্বর ও সর্দি। এছাড়াও গায়ে গুটি গুটি দাগ। সন্তানের চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে নিয়ে আসেন কুড়িলের বাসিন্দা বাবা আবুল কালাম হিমেল এবং মা রাবেয়া খাতুন। তারাই জানালেন, এখানে দ্বায়িত্বরত চিকিৎসক শাহরিয়ারকে রেফার করে দিয়েছেন শিশু হাসপাতালে।
এধরনের দুয়েকজন রোগীর দেখা মিলল যাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে দেয়া হয়েছে।
হাসপাতালের দোতলায় গিয়ে দেখা যায়, বিশাল আয়তনের ফ্লোরে কিছু কিছু বিভাগ চালু করা হয়েছে। বিভাগগুলোর সামনে রোগীদের বসার জন্যে চেয়ারের সারি থাকলেও তার প্রায় সবটাই ফাঁকা পড়ে আছে।
ঔষধ বিতরণ কেন্দ্রটি আংশিকভাবে চালু হয়েছে। তবে স্যালাইন, প্যারাসিট্যামল জাতীয় প্রাথমিক কিছু ঔষধ ছাড়া আর কিছু নেই।
মেডিকেল স্টোর লেখা কক্ষে বাড়তি ও পরিত্যাক্ত মালপত্রের গোডাউন। ব্যাংকের জন্য নির্ধারিত স্থানটিও ব্যাবহৃত হচ্ছে গোডাউন হিসেবে। তথ্য কেন্দ্রেটি পড়ে আছে ফাঁকা। এখনো চালু হয়নি অপারেশন থিয়েটার (ওটি)।
জরুরি বিভাগের দিকে এগিয়ে গিয়ে একজন মেডিকেল অফিসার এবং তিনজন নার্সের দেখা মিললো।
তারাই জানালেন, হাসপাতালে এখনো আল্টাসনোগ্রাফি মেশিন, সিটি স্ক্যান মেশিন আসেনি। ফলে রোগীকে এসব পরীক্ষার জন্যেও অন্য হাসপাতালে রেফার করে দিতে হচ্ছে। দুপুরের পর জরুরি বিভাগটি ছাড়া পুরো হাসপাতালই বন্ধ থাকে।
৫০০ শয্যার হাসপাতালটিতে এপর্যন্ত চালু হয়েছে ৯০ টি শয্যা। বাইরে থেকে পুরো দস্তুর ১২তলা ভবন দেখা গেলেও ভেতরের কাঠামো গড়ে উঠেছে ৪র্থ তলা পর্যন্ত।
দ্বিতীয় তলায় রয়েছে হাসপাতালের পরিচালক, উপ-পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের কক্ষ। জনসংযোগ কর্মকর্তার জন্য কক্ষ রয়েছে কিন্তু কেউ নেই। তবে সেখানে একটি টেবিলের ওপর নার্সদের হাজিরা খাতাটি চোখে পড়লো।
এছাড়া যে দু-চারটি ডেস্কের সাজ-সজ্জ্বা দেখে চালু বলে মনে হচ্ছিলো সেগুলোতেও মিললো না কোনো জন-মানুষের উপস্থিতি।
ঘড়ির কাটায় তখন বেলা ৩টা। বিশাল ফ্লোরগুলো সম্পূর্ণ ফাঁকা। হেঁটে চলতে নিজের জুতোর শব্দই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছিলো নিজ কানে।
তবে কিছু কিছু কক্ষে কোন জনমানুষ না থাকলেও দেখা গেলো ঘুরছে ফ্যান, জ্বলছে লাইট। এ ফ্লোরেই রয়েছে হাসপাতালের সুসজ্জিত সম্মেলন কেন্দ্র।
সর্বসাধারনের জন্যে ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা সেবা দেয়ার লক্ষে প্রতিষ্ঠিত হলেও হাসপাতালে রোগী দেখা হয় বেলা ২টা পর্যন্ত। এরপর দাপ্তরিক ভাবেও বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালটি। প্রশাসন থেকে শুরু করে চিকিৎসক, নার্স, আয়া কেউই থাকেন না।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা আড়াইটায় হাসপাতালটিতে যেয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের একজন মেডিকেল অফিসার এবং ৪ জন নার্স এবং দুজন দাড়োয়না ছাড়া পুরো হাসপাতাল কমপে¬ক্সে কেউ নেই। পুরো হাসপাতাল যেন ভুতুড়ে বাড়ি।
এ সময় দেখা যায়, আউটডোরের অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে বার্ন ইউনিট এবং ভ্যাক্সিন ও টিকাদান কেন্দ্রও বন্ধ রয়েছে।
এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ৩টায় হাসপাতালটিতে যেয়ে দেখা যায়, খাঁ খা করছে পুরো ভবন। এ সময় দেখা যায়, চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ছেলেকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন ভাষানটেকের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। কোলে থাকা আড়াই বছরের শিশু রাফসান জনি পেটের পীড়ায় ভুগছে। তাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে রেফার করা হয়েছে বলেই জানান তিনি।
এদিন পরিচালকের কক্ষে যেয়ে দেখা যায়, এসি (শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ) স্থাপনের কাজ চলছে।
হাসপাতালটি আংশিকভাবে আধাবেলার জন্য চালু হলেও এখানকার সবাই যে পুরোবেলার চাকরি করছেন তা নিশ্চিত করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জন।
অন্য সব সরকারি হাসপাতালের মতো কুর্মিটোলা হাসপাতালেও রয়েছে রোগীদের জন্যে বিনামূল্যে ওষুধ এবং ইনডোরে ভর্তি হওয়া রোগীদের বিনামূল্যে খাবারও সরবরাহের সুবিধা।
১০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে দেয়া হয় আউটডোরে চিকিৎসা সেবা। ইনডোরে চিকিৎসাসেবা নিতে হলে ১৫ টাকার টিকিট কিনতে হয়।
এখানে গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী আসেন বলে জানিয়েছেন হাসাপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, লোকবল, চিকিৎসক এবং যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে হাসপাতালে। তাই রোগীদের এখনো বেশিরভাগকেই অন্য হাসপাতালে রেফার করে দিতে হচ্ছে।
দেখা যায়, ১৮টি বিভাগের চিকিৎসা সেবা দেয়ার লক্ষে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে দেয়া হচ্ছে মাত্র আটটি বিভাগে আউটডোর সেবা। এই বিভাগগুলো হচ্ছে, মেডিসিন, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিক্স, গাইনি, সার্জারি, চক্ষু, ইএনটি এবং চর্ম ও যৌন ।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ প্রতিষ্ঠানে ৯৯৬ জনবলের অনুমোদন থাকলেও এখন পর্যন্ত নিয়োগ হয়েছে চার ভাগের একভাগ।
জনবল সংকটের ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন গত ১০ অক্টোবর বুধবার বাংলানিউজকে বলেন, জনবল নিয়োগ হচ্ছে। হাসপাতালে বর্তমানে ডাক্তার রয়েছেন ৮০ জন। সেপ্টেম্বরে ৬০ জনের ওপর নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে, নার্স নিয়োগ হয়েছে ৭১ জন। হেলথ অ্যাসিসটেন্ট রয়েছেন ১৮ জন এবং ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী রয়েছেন ৫৬ জন। এছাড়াও দ্বায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
সেবাদানের প্রসঙ্গে তিনি জানান, বর্তমানে সল্প পরিসরে সাইকোলজি বিভাগেরও কাজ চলছে, এটি যোগ করলে মোট ৯টি বিভাগের সেবা রয়েছে।
গত ডিসেম্বর থেকে প্যাথলজি ও রেডিওলজি বিভাগও চালু রয়েছে এবং এখন কিছু কিছু অপারেশনও করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নাসিরউদ্দিন জানালেন, কোরবানির ঈদের পর ইনডোরে আরো বেশ কিছু সেবা চালু করা হবে। তিনি বলেন, আশা করছি ধীরে ধীরে মানুষ এ হাসপাতালের সেবা গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৩
এমএন/এমএমকে/আরআইএস