হিউম্যান করোনা ভাইরাস OC43, হিউম্যান করোনা ভাইরাস 229E, সার্স করোনা ভাইরাস ২০০৩ সালে, হিউম্যান করোনা ভাইরাস NL63 ২০০৪ সালে, HKU1 ২০০৫ সালে এবং মার্স করোনা ভাইরাস ২০১২ সালে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। ২০১৯ সালে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম নভেল করোনা ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে।
নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে ৩২৮১ জন মারা গেছেন। মৃত্যুর দিক থেকে ইতালি চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ১৯৭টি দেশ ও অঞ্চলে এ রোগটি ছড়িয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে ৪২২,৮২৯ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৮,৯০৭ জন মারা গেছেন। বাংলাদেশেও এ ভাইরাসের বিস্তার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দেশে এ পর্যন্ত ৩৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে চারজনের।
সেলফ কোয়ারেন্টিন (Quarantine) বা আইসোলেশন (Isolation) শব্দগুলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত হলেও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিল না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং (Social Distancing) এবং লক ডাউন (Lock Down)।
জনসাধারণকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা সেলফ কোয়ারেন্টিন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াত সীমিত বা বন্ধ করতে গোটা এলাকা লক ডাউন করে দিচ্ছে প্রশাসন।
সামাজিক দূরত্বের ক্ষেত্রে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখবে যেন করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হতে না পারে।
সেলফ বা হোম কোয়ারেন্টিন কী?
সেলফ বা হোম কোয়ারেন্টিন বলতে বোঝায়, করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ব্যক্তি, স্বেচ্ছায় বা সরকারি বাধ্য বাধকতায় অন্তত ১৪ দিন নিজ বাড়িতে অবস্থান করবেন। এসময় তিনি সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ রাখবেন এবং পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখবেন।
আইসোলেশন কী?
আইসোলেশন একজন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যিনি সম্পূর্ণ সুনিয়ন্ত্রিতভাবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ১৪ দিন বসবাস করবেন। কোভিড-১৯ একটি সেলফ লিমিটিং ডিজিস অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময় পর এ ভাইরাস সংক্রমণের সুযোগ না পেলে আর বিস্তার লাভ করতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে কোয়ারেন্টিনে থাকার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব প্রকট। এর প্রভাবে কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ, রাগ, ঘুমের সমস্যা, বিষণ্ণতা দেখা দেয় এমনকি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) হতে পারে। ২০০৩ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কোয়ারেন্টিনে থাকা ১০-২৯ শতাংশ ব্যক্তিই পিটিএসডিতে ভুগছেন। ৩১ শতাংশ রোগী আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় বিষণ্ণতায় ভোগেন।
কোয়ারেন্টিন বিষয়ক ঝুঁকি বা চাপ তা থেকেই এ মানসিক রোগ দেখা দেয়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়, হতাশা, বিরক্তি, সমর্থনের অভাব, গুজব, ভুয়া তথ্য, আর্থিক ক্ষতি বা সোশ্যাল স্টিগমা কোয়ারেন্টিনে থাকা রোগীর মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। এ মানসিক চাপ বা ঝুঁকি, যাদের মানসিক রোগ রয়েছে এবং যাদের মানসিক রোগ নেই উভয়কেই সমানভাবে প্রভাবিত করে।
কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় অস্থিরতা বা মানসিক সমস্যার উপসর্গগুলো হলো:
১) নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ভয় বা উদ্বেগ
২) ঘুমের সমস্যা
৩) খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
৪) দীর্ঘমেয়াদী অভ্যাসের পরিবর্তন
৫) ধুমপান, মদ বা নেশাজাত দ্রব্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া।
হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিচের কাজগুলো করতে হবে:
১। রুটিন মাফিক কাজ করুন
সময় মতো গোসল, আহার, পরিষ্কার কাপড় পরুন। নিজেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে করুন।
২। দৈনন্দিন কাজ
নিজেকে সারাদিন ব্যস্ত রাখতে বইপড়া, হাতের ছোটখাটো কাজ, ল্যাপটপে বা ডেস্কটপে কাজে ব্যস্ত থাকুন। টিভি দেখা, গান শোনার মতো আনন্দদায়ক কাজ করুন।
৩। শরীরের যত্ন
হালকা ব্যায়াম করা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে এবং পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
৪। যোগাযোগ রাখুন
মোবাইল, ইমেইল, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম বা অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।
৫। তথ্য গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করুন
মিথ্যা-বিভ্রান্তিকর তথ্য, গুজব, ভিত্তিহীন সংবাদ অস্থিরতা তৈরি করে যা মানসিক রোগের কারণ। তাই ভিত্তিহীন সংবাদ পরিহার করুন। দিনের নির্দিষ্ট সময় নির্ভরশীল উৎস থেকে তথ্য নিন। যেমন: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), সিডিসি, ডিজিএইচএস, আইইডিসিআর, ইত্যাদি।
৬। বিরক্তি দূর করুন
যে কাজগুলো করতে আপনি পছন্দ করেন, তা অল্প সময়ের জন্য হলেও প্রতিদিন করুন। আপনার পছন্দের গান, নাটক, সিনেমা দেখুন বা ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ুন। এতে বিরক্তিবোধ কমবে। ধর্মীয় অনুশাসন যেমন – নামাজ, ধর্মীয়গ্রন্থ পড়া, পূজা বা আরাধনা ইত্যাদি বাড়িতে পালন করুন।
৭। নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি
কখনো কখনো নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হলে, টেলিফোনে স্বাস্থ্য সহায়ক কেন্দ্রে ফোন দিয়ে কাউন্সেলিং নিন। অত্যধিক কাজ বা সংবাদ পরিহার করুন। মেডিটেশন করুন, এতে মনে প্রশান্তি আসে।
৮। ইতিবাচক চিন্তা করুন
আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগ সুস্থ হচ্ছেন এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের পর সুস্থ হয়েছেন, এমন কারো অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করুন।
৯। বাড়ির অন্য সদস্যদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন
বাড়ির অন্য সদস্যরা যেন অসুস্থ না হয়, তাই তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন। আপনার সুস্থতা বাড়ির অন্য সদস্যদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করবে।
১০। টেলিমেডিসিন
শারীরিক বা মানসিক যেকোনো অসুস্থতার জন্য টেলিফোনে বা টেলি কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা নিন।
সেলফ বা হোম কোয়ারেন্টিনের ১৪ দিন যেন আপনি নিজেকে প্রফুল্ল রাখতে পারেন। মানসিক ও শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারেন। এ সময় মানসিক রোগে যেন আক্রান্ত না হন, সেজন্য আপনাকে নির্ভরযোগ্য তথ্য জানতে হবে এবং সময়গুলো সুন্দরভাবে কাটাতে হবে। করোনা ভাইরাসকে ভয় নয়, জয় করতে হবে। আপনার সুস্থতাই পরিবার ও সমাজের নিরাপত্তা এবং জাতির সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
লেখক: ডা. মো. রশিদুল হক, সহকারী অধ্যাপক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, এবং দপ্তর সম্পাদক, এফডিএসআর।
বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২০
এফএম