ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

দেশে প্রতি ১২ জনের মধ্যে ১ জন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৮ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০২১
দেশে প্রতি ১২ জনের মধ্যে ১ জন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত

ঢাকা: দেশে ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের প্রতি ১২ জনের মধ্যে একজন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। আইসিডিডিআর,বি এবং এনআইএনএস দ্বারা পরিচালিত জাতীয় এক সমীক্ষা এমন তথ্য উঠে এসেছে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশে সাতটি বিভাগের শহর এবং গ্রামীণ অঞ্চলের ২ হাজার ৭৯৬ জন ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়েছে। এই জরিপের মাধ্যমে বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়া এবং প্রধান অসংক্রামক রোগ বিস্তারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই গবেষণায় বয়স্ক ব্যক্তিদের ডিমেনশিয়ার প্রকোপ, অঞ্চল ভিত্তিক এর ভিন্নতা এবং স্বাস্থ্যসেবার ধরন পর্যালোচনা করা হয়েছে।

বুধবার (৩০ জুন) ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে একটি ওয়েবিনারের বাংলাদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার ব্যাপকতা জাতীয় সমীক্ষার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।

আইসিডিডিআর,বি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ
কর্মসূচি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্স অ্যান্ড হসপিটালের যৌথ সহযোগিতায় এ সমীক্ষা পরিচালিত হয়।

ওয়েবিনারের গবেষণার ফল উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআর,বি-র ইনিশিয়েটিভ ফর নন-কমিউনিকাবল ডিজিজ ইউনিটের প্রধান এবং গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ড. আলিয়া নাহিদ।

ওয়েবিনারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর প্রফেসর ডা. রোবেদ আমিনের সভাপতিত্বে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম, আইসিডিডিআর,বি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. তাহমিদ আহমেদ, জাতীয় ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর কাজী দ্বীন মোহাম্মদ প্রমুখ।

ওয়েবিনারের জানানো হয়, ডিমেনশিয়া এমন একটি সিনড্রোম যেক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং প্রতিদিনের ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের ডিমেনশিয়া রয়েছে এবং এর ৬০ শতাংশ নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশে বসবাস করে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে খুব কম তথ্য রয়েছে যা প্রবীণ নাগরিকদের সেবা দিতে নীতি নির্ধারকদের একটি বাস্তবমুখী কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

অন্যদিকে, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশিরভাগ প্রোগ্রাম প্রজননক্ষম বয়সের মানুষকে কেন্দ্র করে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।

গবেষণায় পাওয়া গেছে, প্রতি ১২ জন ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে একজনের ডিমেনশিয়া দেখা গেছে এবং নারীদের মধ্যে সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় ডিমেনশিয়ার প্রকোপ ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি। অন্যান্য বিভাগের তুলনায় রাজশাহী এবং রংপুরে (১৫ শতাংশ এবং ১২ শতাংশ) ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বেশি এবং শহরে এবং গ্রামীণ অঞ্চলে (৮ শতাংশ)-এর মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়নি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বাড়ে।

ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা কখনও স্কুলে যায়নি এবং যাদের স্ত্রী বা স্বামী নেই
সামগ্রিকভাবে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ তাদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে বেশি দেখা গেছে।

ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্ধেকেরও বেশি হাইপারটেনশন (৫২ শতাংশ), হতাশা (৫৪ শতাংশ), এবং ডায়াবেটিসসহ (৮ শতাংশ) এক বা একাধিক দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা (মাল্টিমর্বিডিটি) ছিল।

এই গবেষণায় বলা হয়, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি পুষ্টির অভাব (৩৫ শতাংশ কম ওজন), স্বল্প শারীরিক ক্রিয়াকলাপ (৪৯ শতাংশ), উচ্চমাত্রায় লবণ গ্রহণ (৫৬ শতাংশ) এবং উচ্চমাত্রায় তামাক সেবন (৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ) করতে দেখা গেছে যা সাধারণত নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের মধ্যে ঝুঁকির কারণ। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় সবারই (৯০ শতাংশ) গত ৬ মাসে স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হয়েছে বলে জানা গেছে এবং তারা চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে (১২ শতাংশ) ও সরকারি হাসপাতালের (৫ দশমিক ৪ শতাংশ) যোগ্য ডাক্তারদের চেয়ে প্রায়শই কোনও ওষুধ বিক্রেতার কাছে (১৬ দশমিক ৬ শতাংশ) গিয়েছিলেন। এই স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ধরনটি রোগীদের লিঙ্গভিত্তিক, বসবাসের স্থান (নগর বা গ্রামীণ অঞ্চল) ভিত্তিক কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সঅ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক এবং গবেষণার কো-পিআই অধ্যাপক ড. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, সমাজের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে, তাই খুব বিলম্বে রোগ নির্ণীত হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগী হয়ে আমাদের ডিমেনশিয়া নিয়ে আরও গবেষণা চালানো দরকার, যাতে আমরা ডিমেনশিয়া বাড়ার কারণ শনাক্ত এবং এটির উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি।

প্রফেসর ড. রোবেদ আমিন বলেছেন, বিশেষত বহু রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিরা কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। তবুও, আমাদের কাছে প্রবীণদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সামগ্রিক পরিষেবা মডেল নেই। তাই, সরকারি, বেসরকারি এবং গবেষণা সংস্থার প্রচেষ্টায় এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য একটি সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ড. আলিয়া নাহিদ বলেন, বার্ধক্য অনস্বীকার্য এজন্য বয়স্ক ব্যক্তির যত্নকে কেন্দ্র করে সহানুভূতিশীল সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের গবেষণার তথ্য-উপাত্তগুলো প্রচলিত বায়োমেডিক্যাল
পদ্ধতির বাইরে এক বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা মডেল তৈরি করতে সহায়তা করবে।

তিনি আরও বলেন, 'এটি একটি জীবনচক্রীয় পদ্ধতির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ব্যবস্থাগুলো সংহত করতে এবং অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি হ্রাস এবং বার্ধক্য বয়সে ডিমেনশিয়ার মতো দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা মোকাবিলায়ও সহায়তা করবে।

সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে যে ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ডিমেনশিয়া রোগের

সংখ্যা ছিল ১ দশমিক ১ মিলিয়ন, এদের মধ্যে শূন্য দশমিক ২৮ মিলিয়ন পুরুষ এবং শূন্য দশমিক ৮৮ মিলিয়ন নারী। এই গবেষণাটি আরও দেখিয়েছে যে, ২০২৫ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ১ দশমিক ৩৭ মিলিয়নে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণেরও বেশি হবে (২ দশমিক ৪ মিলিয়ন)। যদি উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

এই গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে যে, বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের পরিবার, সমাজ, বেসরকারি এবং সরকারি পর্যায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি এদেশে একটি উদ্ভাবনী স্থানীয় প্রমাণভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ কমানো যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ০২১০ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০২১
পিএস/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।