ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

শোকের ১৩ দিন, তবু জীবনের জয়গান

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৫
শোকের ১৩ দিন, তবু জীবনের জয়গান ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

থামেল (কাঠমান্ডু) থেকে: যারা বিশ্বাস করেন, ১৩ সংখ্যাটি অপয়া (আনলাকি), তারা সংখ্যাটি এড়িয়ে চলেন। কিন্তু নেপালের শোকাতুর নাগরিকরা পালন করছেন ১৩ দিনের শোক।

সেই সঙ্গে গাইতে শুরু করেছেন জীবনের জয়গান।
 
সবার ‘১৩ দিন’ একসঙ্গে শুরু নয়, বেশিরভাগের শুরু গত ২৫ এপ্রিল থেকে।
 
এদিন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে নেপাল, হাজার হাজার নিহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা এখন সারাবিশ্বের জানা। কেউ কেউ তখনি হয়েছেন মহাকাশের তারা, আর কেউ তার পরে, আহত হয়ে কষ্টে ভুগে।
 
নিহতদের স্বরণে-সম্মানে নেপালে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা হয় তিনদিনের, যথাযথ সম্মানের সঙ্গে পালিত হয়েছে অবিরাম অশ্রু ও আতঙ্কে। যার রেশ এখনো কাটেনি।

কিন্তু স্বজনহারাদের শোক চলবে টানা ১৩ দিন। প্রিয়জনের মঙ্গলের জন্য তাদের পালন করতে হয় কিছু ধর্মীয় আচার।
 
জানা গেল, নেপালের হিন্দুরা যেসব রীতি কঠোরভাবে পালন করেন, তার অন্যতম এই শোকপালন।
 
নিয়মিত পূজা-অর্চনা করেন কাঠমান্ডুবাসী হেমবাদুর নিউপানে।
 
তার সঙ্গে আলাপে জানান, যাদের বাবা বা ভাই হারিয়েছেন তারা এর পরের ১৩ দিন ধর্মীয় এ আচ‍ার পালন করবেন।
 
ভেঙে যাওয়া মন্দিরগুলো ঘুরে ঘুরে পূজা দিতে এসেছেন হেমবাদুর নিউপানে।
 
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘যিসকা বাপ মারা, ভাই মারা, কোয়ি খাস রিস্তেদার চাল বাসে, ওলোগ তেরা দিনোমে নুন নেহী খা সাকতে। স্রিফ সফেদ চাওল, ঘি অর আদ্রক খা সাকতে’ (যাদের বাবা, ভাই বা কাছের কোন আত্মীয় মারা যাবে, তারা তের দিন লবণ খাবে না। সাদা ভাত, ঘি ও আদা খেতে পারবে)।
 
নিউপানে বলেন, ‘উন দিনোমে রঙিন কাপড়া প্যাহেন না মানা হ্যায়। সফেদ কাপড়া, সেলাই ভি নেহী হুয়া, অ্যায়সা প্যাহেন না পড়তা হ্যায়। আদমী লোগোকো সারভি মুড়ানা পড়তা হ্যায় (এই দিনগুলোতে রঙিন কাপড় পরা যাবে না, সাদা পোশাক পরতে হবে, যে পোশাকে কোনো সেলাই পড়েনি। পুরুষরা চুলও ফেলে দেবেন)। ’

এ সময়টিতে পিন্ডদান করতে হয়, ব্রাহ্মণদের খাওয়াতে হয় ও কিছু দান খয়রাতও করতে হয় বলে জানান নিউপানে।
 
ধর্মপ্রাণ এ ব্যক্তি আরও বলেন, ইয়ে কারণে মে মরাহুয়াকো সুকুন মিলতা হ্যায়, করনেওয়ালোকো ভি বহতই পূণ্যি মিলতা হ্যায় (এ শোক পালনে মৃতের আত্মার শান্তিলাভ হয় ও যিনি এসব পালন করলেন তারও অনেক পূণ্য হয়)।
 
এতো গেল শোকের কথা। কিন্তু সেই শোককেই যেন ইতোমধ্যে শক্তিতে পরিণত করতে শুরু করেছেন আশাবাদী ও ধৈর্যশীল মানুষ।
 
অত্যন্ত পরিশ্রমী ও বিনয়ী মানুষগুলো নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
 
২৫ এপ্রিলের পর রোববার (০৪ মে) কাঠমান্ডু শহর, ললিতপুর, ত্রিকোণ, বখতপুরসহ কিছু এলাকার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা আগের চেয়ে বেশি দেখা গেছে।
 
আরও আশা জাগায় ললিতপুরের দরবার স্কয়ার সংলগ্ন লোকালয়ের কিছু চিত্র। হেলে পড়া ও কিছুটা ভেঙে পড়া বাড়ি মেরামতের চেষ্টা করছে অনেক পরিবার। এক গলিতে দেখা গেল, কাঠে পেরেক ঠুকে বাড়িটি তুলে রাখার চেষ্টা করছেন পুরুষরা, নারীরা বসে রয়েছেন উঠোনে।

হেলে পড়া বাড়িগুলো মোটা ও মজবুত কাঠ দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার চেষ্টা চোখে পড়ে বখতপুরে। ব্যাপক ক্ষতির শিকার এ এলাকাটিতে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে অনেক পরিবার। নিত্য কাজ ও ব্যবসা শুরু করেছেন তারা।
 
বখতপুরের ইত্তেচান-১৫ রোডে পরিচিত ও নামকরা দইঘর ‘বখতপুর কিং কার্ড’ আবার খুলেছেন মালিক মঙ্গলা।
 
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘পেট ভূচাল নেহী সামঝতে, পেটতো খানা চাহতা হ্যায়, পিনা চাহতা হ্যা, শোনা ভি চাহতা হ্যায়। তো দুকান নেহী খুলেগা ফের ক্যায়া কারেগা? (পেট ভূমিকম্প বোঝে না, খেতে চায়, পান করতে চায়, ঘুমাতে চায়। তাই দোকান না খুলে আর কীইবা করার আছে)। ’
 
মঙ্গলার দোকান ঘেঁষে যে বাড়িটি, সেটিতে থাকতেন কুন্ঠি কায়স্থ। এখন এতই ফাটল সেটিতে, কুন্ঠির আশ্রয় তাঁবু।
 
তিনিও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হচ্ছেন বাস্তুহারা জীবনে, নতুন করে বাঁচার পরিকল্পনা করছেন বলে জানালেন।
 
পর্যটন এলাকা থামেলেও ফিরছে প্রাণ। রোববার রাতে দেখা গেল, বেশ কিছু দোকান-পাট খোলা হয়েছে। একটি ডিসকো বার থেকে ভেসে আসছিল উচ্চ বাদ্যযন্ত্র ও গানের শব্দ। রাস্তায় পথচারী বেড়েছে।  

কাঠমান্ডু ভ্যালির সবচে’ পুরনো জায়গা ললিতপুরের পাটান। এখানে মন্দিরগুলোর মধ্যে কৃষ্ণমন্দির ঠিক থাকলেও বাকিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত। কোনটি ভেঙেছে, কোনটিতে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন নেপালের আর্মড পুলিশ ফোর্সেস।
 
এমন ধ্বংসস্তুপকে সামনে রেখেও দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে আশপাশে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরার প্রচেষ্টা সবদিকে চোখে পড়ে।
 
উদ্ধার কাজ পরিচালনায় উপস্থিত সেনা কর্মকর্তা কুনওয়ার ডিবি বাংলানিউজকে বলেন, ‘দিস ইজ দ্যা সিস্টেম অব নেচার, ট্রুথ অব লাইফ। এন্ডমে সব কুছ ঠিক হো যাতা হ্যায়, জাস্ট ওয়াক্ত দেনা পড়তা হ্যায়, অর ক্যায়া? নেপাল ফিরসে ঠিক হো জায়েগা। লোগ মুসকুরায়েগা ফিরসে। উই হোপ!
 
(এটাই প্রকৃতির নিয়ম, জীবনের সত্য। শেষে সব ঠিক হয়ে যায়, শুধু একটু সময় দিতে হয়, আর কী? নেপাল আবার ঠিক হবে, মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। আমরা আশা করি!)
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৫
এসকেএস/জেডএম

** নিস্তব্ধ পশুপতি, ভিড় কেবল চিতাঘাটে
** আড়ালেই ঝুরঝুরে নিম্বু-ভূতুড়ে ধর্মস্থালী
** দরবার স্কয়ার এখন তাবুর স্কয়ার
** বিমানবন্দর থেকে বেরুতেই নাকে লাশের গন্ধ
** সাজেদা সুইটি এখন কাঠমান্ডুতে
** বিপন্ন নেপালে যাচ্ছেন সাজেদা সুইটি
** বিমানের কাঠমান্ডু ফ্লাইট বিলম্বিত

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।