ঢাকা, সোমবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ঘর বানাই দৌ, গোরি খানে দৌ

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৩ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৫
ঘর বানাই দৌ, গোরি খানে দৌ

সিন্ধুপাল চক (নেপাল) ঘুরে: সিন্ধুপাল চকের যে কয়টি গ্রাম ঘোরা সম্ভব হলো, ক্ষতিগ্রস্তদের একটাই চাওয়ার খোঁজ পাওয়া গেল। ‘ঘর বানাই দৌ, খানে চিজ হামি আপাই খানে সাকসু (বাড়ি বানিয়ে দাও, শস্য আমরা ফলিয়ে খাব)’, বলছেন তারা।


 
ত্রাণ নয়, দান নয়, ভিক্ষা নয়- তারা নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে চান। সর্বস্ব হারানো এ মানুষগুলোর কাছে সেই পরিমাণ টাকা নেই, যা দিয়ে থাকার ব্যবস্থা নিজেরাই ঠিকঠাক করে নিতে পারেন।
 
সেভাবে কোনো ত্রাণ বা তাবু আসেনি তাদের কাছে। সেসব চানও না তারা। অস্থায়ী সহযোগিতায় বিশ্বাসী নন ভাঙা-ফাটা ঘরের এ মালিকরা।
 
ঘর গড়তে সহযোগিতা চান শুধু। সরকার থেকে হোক বা বিদেশি সহযোগিতা, তাদের এখন ঘর প্রয়োজন।
 
ভিনটার গ্রামে একসঙ্গে স্বামীহারা হয়েছেন শাশুড়ি মাচ্ছেরি মাজি ও পুত্রবধূ বিমলা মাজি। ঘর ভেঙেই বাবা সুকুমান মাজি ও ছেলে শিভে মাজির মৃত্যু হয়েছে ২৫ এপ্রিলের সর্বনাশা ভূমিকম্পে। শোকে স্তব্ধ মাচ্ছেরি সিগারেট ফুঁকছেন অস্থির চোখে, আর কিশোরী বিমলা বাক্যহারা, ফোলা চোখ।
 
স্বামীহারা দুই নারীর ঠিকানা এখন ছাপড়াঘর। তারা জানেন না এভাবে আর কতদিন।
 
এক হাত সেভাবে কাজ করে না বলরামের। নিজেই কিশোর, বিয়ে করে ছেলে বলবীরের বাবা হয়েছিলেন। কিন্তু স্ত্রী মরে ছেলেটা এতিম হয়ে গেছে। অকেজো হাতে ছেলেকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোই তার জন্য বিশাল কষ্টের হয়ে যায়।
 
গ্রামের সবচে বড় মওকানের (ঘর) ছেলে বলরাম-বলবীর আজ পথে নেমে গেছেন। ঘরই নেই, কীভাবে কী করবেন নিজে বা বাচ্চাকে নিয়ে, কিছুই ভাবতে পারছেন না তিনি।
 
প্লাস্টার করা পা নিয়ে শিপাঘাটের রাস্তায় বসে তরুণী মা মায়াদেবী। চার মাসের বাচ্চা তার। থাকার জায়গা নেই কোথাও। আহত পা নিয়ে রাস্তায় দিনাতিপাত। কথা বলার ভাষা যেন হারিয়ে গেছে তার। হারিয়ে গেছে অনেক অনুভূতি। মুক্ত আকাশের নিচে নির্বিকার ভঙ্গিতে শিশুকে স্তন্যদানের দৃশ্য কারও কাছেই সুখকর হওয়ার কথা নয়।
 
আলাপে বলছিলেন, সুস্থ হতে চান বাচ্চার জন্য। ঘর নাই, ঘর পেলে খাবার নিজেই জুটিয়ে নিতে পারবেন।
 
শিপাঘাট ব্রিজের কাছে ভাঙা লোকালয়ের ১৬টি পরিবার এখন তাবুতে। তাদের চাওয়া একটাই- ছোট্ট করে একটু থাকার ঘর। ছোট ব্যবসা করতে জানেন, কিংবা ক্ষেতের কাজ। সেসব করেই তাদের খাওয়া জুটিয়ে নিতে পারবেন বলে দৃঢ় আশা।
 
ভিনটার গ্রামের ১শ’ ৩০টি বাড়ির সবকটি ভাঙা, এখানে মারা গেছেন ১৮ জন মানুষ। ৮শ’ মানুষের এখন কোনো থাকার জায়গা নেই। তারা বেশিরভাগই ঘর-গৃহস্থালি করেন। জমি যেহেতু রয়েছে, থাকার জায়গাটি থাকলে কোনোভাবে জীবন চালিয়ে নিতে পারবেন বলে বিশ্বাস।
 
ধোতার গ্রামের অবস্থাও একই রকম। নিরাশ্রয় জীবন যাপন করছেন তারা খোলা আকাশের নিচে।
 
সিন্ধুগ্রামে বেশিরভাগই মাটির ঘর, ভেঙে গুড়িয়ে গেছে।
 
সিন্ধপাল চকে যাতায়াতের পাহাড়ি রাস্তার দু’পাশে কোনো অক্ষত বাড়ি চোখে পড়ে না। সরকারি হিসেবেও বলা হয়েছে, ৯৫ ভাগ বাড়িঘরের ক্ষতিগ্রস্ততার কথা। কিন্তু চোখের দেখা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্যমতে ৯৯ ভাগ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত ও বসবাসের অযোগ্য।
 
পাহাড়ের সুউচ্চ কোলে তিনগাড়ে গ্রাম। ছোট্ট গ্রামটিতে ছেলে, পুত্রবধু ও নাতি সন্দীপ পৌড়েলকে নিয়ে বাস করেন বিষ্ণুমায়া পৌড়েল।
 
বিষ্ণুমায়া জানান, তার গ্রামের বাড়িঘর সব ভেঙে গেছে। মারা গেছে ছয় জন। প্রতিবেশী গ্রামে যথাক্রমে দুইজন, সাতজন ও আটজন মানুষ মারা গেছেন।
 
ঢুসেনি গ্রামে ১শ’ ৬৫টি ঘর ছিল, যার সবই এখন বসবাসের অযোগ্য। এ গ্রামের প্রেমপ্রসাদ ও মণীপ্রসাদের বাড়ি ভেঙেছে। কাঠমান্ডুতে তাদের ছোট একটি বাড়ি থাকায় রক্ষা। সেখানেই চলে যাবেন সব গুছিয়ে।
 
বলতে বলতে ধুতির খোটে চোখ মোছেন প্রেমপ্রসাদ। ৩৩ বছরের সংসার তাদের। স্বামী-স্ত্রী তিল তিল করে সোনার সংসার গড়েছেন। চোখের সামনে সব শেষ। বাড়ি-ঘর আর পাহাড় ছেড়ে এখন যেতে হবে ছেলের সংসারে। সম্মানিত পরিবারের বড়কর্তা প্রেমপ্রসাদ। তার কষ্ট কেউ বুঝবে না বলেই ‍চুপচাপ হয়ে থাকেন।
 
শীতলপ্রসাদ আচার্য্য সাদা ও সেলাইবিহীন পোশাকে বাবা-মার আত্মার শান্তিতে পুজো দিচ্ছেন পাহাড়ের খাঁজে বসে। ভূমিকম্পের প্রথম ঝটকায় তারা ইহলোক ছেড়েছেন। ঘর-পরিবার সব হারানো এ তরুণও প্রেমপ্রসাদের মতোই নিশ্চুপ।
 
এখানে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে কান্না। বিশাল পাহাড়ে ছোট্ট ছোট্ট বসতি এক নিমিষে কষ্টের কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। একদিকে ভাঙা বাড়ি, অন্যদিকে তাবুর সারি- এটাই এখন সিন্ধুপাল চকের চিত্র।
 
বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হোটেল- যা কিছু সামান্য ছিল, সবকিছুই এখন ক্ষতিগ্রস্ত। ভূমিকম্পে আহতরা নির্ভর করছেন গ্রামের টোটকা বা কবিরাজী চিকিৎসায়।
 
যাদের জীবন এমন হয়েছে, ১২ থেকে ১৫ দিনের শুকনো খাবার ত্রাণ হিসেবে পেয়ে সেটি খুব একটা উপকার হবে না- বলছেন তারা।
 
শুধু সিন্ধুপালই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত নেপালের বেশিরভাগ বাস্তুহারার এটাই এখন মূল চাওয়া- রুপিয়া। প্রতিটি লোকালয়ের মানুষ সত্যিকার অর্থেই রাস্তায় নেমে পড়েছেন। তারা ঘরে ফিরতে চান, করে খেতে চান। তারা বসবাসের ব্যবস্থা চান।
 
পাহাড়ি পথগুলোতে ফাটল ধরেছে বড় ভূমিকম্পে। প্রতিদিন কয়েকবার করে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়ে রাস্তাগুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। চলাচল হয়ে পড়েছে বিপজ্জনক। এখানে জীবন ও মৃত্যু যেন সহোদর। এ ঘরহারাদের কষ্ট কেবল ভুক্তভোগীরাই হয়তো বুঝবেন।
 
ক্ষতিগ্রস্ত নেপালী মানুষগুলোর আত্মসম্মানবোধ টনটনে। এখন একটাই তাদের আকুতি, ‘মোলাই ভিখ চাইদাই না, গোরি খানে দো (আমরা ভিক্ষা চাই না, করে খেতে দাও’।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৫৫৮ ঘণ্টা, মে ০৬, ২০১৫
এসকেএস/এসএস

** জীবন এখানে এমন!
** বিধ্বস্ত নেপালে বাংলাদেশি সংবাদকর্মীরা
** শোকের ১৩ দিন, তবু জীবনের জয়গান
** নিস্তব্ধ পশুপতি, ভিড় কেবল চিতাঘাটে
** আড়ালেই ঝুরঝুরে নিম্বু-ভূতুড়ে ধর্মস্থালী
** দরবার স্কয়ার এখন তাবুর স্কয়ার
** বিমানবন্দর থেকে বেরুতেই নাকে লাশের গন্ধ
** সাজেদা সুইটি এখন কাঠমান্ডুতে
** বিপন্ন নেপালে যাচ্ছেন সাজেদা সুইটি
** বিমানের কাঠমান্ডু ফ্লাইট বিলম্বিত

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।