ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসেই কি অবসান ইউরো যুগের?

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৪ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৫
গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসেই কি অবসান ইউরো যুগের? ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা: ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি চালু হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) রাষ্ট্রগুলোর অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’। ১৬ বছর নির্বিঘ্নে পার করে দেওয়ার পর ২০১৫ সালে এসে যেন শক্তিশালী এই মুদ্রার কানে বাজতে শুরু করেছে ভাঙনের সুর।

এর অন্যতম কারণ গ্রিস।

অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়া দেশটি ঋণখেলাপের দায় মাথায় নিয়ে ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে। তাকে ধরে রাখার ইইউ রাষ্ট্রগুলোর শত চেষ্টা ব্যর্থতার অন্ধকারে এখন প্রায় নিভু নিভু।

চলতি বছর ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসেন গ্রিসের বামপন্থি রাজনৈতিক দল সিরিজা পার্টির নেতা অ্যালেক্সিস সিপরাস। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না হতেই তার সরকার মুখোমুখি হয় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক সংকটের। এই মুহূর্তে দেশটি পার করছে তার ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় অধ্যায়।

সর্বশেষ খবর, মঙ্গলবারের (৩০ জুন) মধ্যে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলকে (আইএমএফ) ঋণের ১.৮ বিলিয়ন ডলার (১৪ হাজার ১০ কোটি টাকা প্রায়) পরিশোধ করতে হবে গ্রিসকে। এছাড়া ১০ জুলাইয়ের মধ্যে ২ বিলিয়ন ইউরো (১৭ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা প্রায়), ২০ জুলাইয়ের মধ্যে সাড়ে তিনি বিলিয়ন ইউরো (৩০ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা প্রায়) মূল্যমানের বন্ড ও ২০ আগস্টের মধ্যে ৩.২ বিলিয়ন ইউরো (২৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার কিছু বেশি) মূল্যমানের বন্ড পরিশোধ করতে হবে। আর এসব ঋণ পরিশোধ তখনই সম্ভব হবে, যখন অ্যালেক্সিস সিপরাসের সরকার আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের সঙ্গে অন্তত ৮.১ বিলিয়ন ডলারের (৬৩ হাজার ৪৪ কোটি টাকা প্রায়) নতুন ‘বেলআউট’ চুক্তি স্বাক্ষর করবেন।

ধসে পড়া অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগকেই মূলত ‘বেলআউট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দেউলিয়া হওয়ার পথে রয়েছে গ্রিসের ব্যাংকগুলোও। গত দুই সপ্তাহে দেশটির ব্যাংকগুলো থেকে এক বিলিয়নেরও বেশি ইউরো (৯ হাজার কোটি টাকা প্রায়) তুলে নেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে শনিবার (২৭ জুন) ‘গণভোটে’র ঘোষণা আসার পরই তুলে নেওয়া হয় অর্ধ বিলিয়নের বেশি ইউরো ( ৫ হাজার কোটি টাকা প্রায়)।

অর্থনীতিকদের ধারণা, ঋণখেলাপের দায়ে ইউরোজোন থেকে গ্রিসের বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন দেশটির জনগণ। এ আশঙ্কায় তারা তাদের অর্থ ফেরত নিচ্ছেন যত দ্রুত সম্ভব। শনিবার এ পরিস্থিতি এতটাই প্রকট ওঠে যে, দেশের সাড়ে পাঁচ হাজার এটিএম বুথের মধ্যে দুই হাজারটিতে মজুত থাকা অর্থ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।

এমন অবস্থায় নতুন বেলআউট চুক্তি করতে হলে সিপ্রাসকে মেনে নিতে হবে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের বেশ কিছু শর্ত। এর মধ্যে নতুন পেনশন কাঠামো নির্ধারণ, সেলস ট্যাক্স বৃদ্ধি ও শ্রমবাজার সংস্কার অন্যতম। তাদের এ দাবি আবার মানতে নারাজ গ্রিক প্রধানমন্ত্রী। এ লক্ষ্যেই তিনি গণভোটের আহ্বান করেছেন। আগামী ৫ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য এ গণভোটে সমর্থন দিয়েছে দেশটির এমপিরাও। রোববার (২৮ জুন) ৩০০ আসন বিশিষ্ট সংসদে ১৭৯ জন সদস্য গণভোটের পক্ষে রায় দেন। ফলে এ সিদ্ধান্তের পক্ষে সিপরাসের সিদ্ধান্ত আরও দৃঢ় হলো বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বর্তমানে অ্যালেক্সিস সিপরাসের একটাই উদ্দেশ্য। যেভাবেই হোক, গ্রিক জনগণকে ‘না’ ভোটে উৎসাহিত করা। বিশ্লেষকদের ধারণা, এতে করে তিনি ঋণদাতাদের বলতে পারবেন, আমার পেছনে গ্রিসের জনগণ আছে, এবার আপনাদের নতুন কোনো শর্ত খোঁজা উচিত।

এদিকে, আইএমএফকে অর্থ ফেরতের ব্যাপারে শেষ তারিখ ৩০ জুন থেকে আরও কয়েকদিন পেছানোর অনুরোধ করেছিলেন গ্রিক প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ইউরোজোনের অর্থমন্ত্রীরা। গ্রিক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভ্যারোউফাকিসও অর্থমন্ত্রীদের ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বৈঠক ত্যাগ করেন। কঠোর এ সিদ্ধান্তের ফলে ৩০ জুনের মধ্যেই দেশটিকে নতুন কোনো বেলআউট চুক্তিতে যেতে হবে।

এদিকে নতুন খবর, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) গ্রিসকে জরুরি অর্থ ঋণ দেওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। রোববার (২৮ জুন) এ ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনাও সেরেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। অর্থাৎ নতুন কোনো বেলআউট চুক্তিতে না গেলে ১ জুলাই থেকে নিশ্চিতভাবেই বন্ধ হচ্ছে ইসিবি’র ঋণ সহায়তা। গ্রিসের ব্যাংকগুলো ইসিবি’র ঋণের ওপর নির্ভরশীল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্ত দেশটির অর্থনৈতিক সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিস অর্থনীতি ধসে পড়াটা ব্যাপক প্রভাব ফেলবে ইউরোপের বাকি অংশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে। দেশটির বর্তমান ঋণের পরিমাণ ৩২০ বিলিয়ন ইউরো (২৭ লাখ ৮১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকার কিছু বেশি)। এর বেশিরভাগই ইউরোজোন সরকারগুলোর কাছ থেকে নেওয়া। এর মধ্যে শুধুমাত্র জার্মানির কাছে গ্রিসের ঋণ ৯২ বিলিয়ন ইউরো (৭ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকার কিছু বেশি)।

যদি ঋণখেলাপের দায়ে ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে যায় দেশটি, তাহলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটকে যাবে। এর ফলে ইইউ রাষ্ট্রগুলোও পড়বে অর্থনৈতিক সংকটে। এর ফলে ইউরোপ মহাদেশের রাজনীতির চিত্র পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি ইইউ রাষ্ট্রগুলোর জোট ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

আর এর পরিণাম, ১৬ বছরের রাজত্ব শেষে ‘ইউরো’ শাসনের পতন।

বাংলাদেশ সময়: ০২৪৪ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৫
আরএইচ/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।