ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে উভয় সংকটে খামেনি-রোহানি

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৫
পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে উভয় সংকটে খামেনি-রোহানি

ঢাকা: পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে উভয় সংকটে পড়তে চলেছে পশ্চিম এশিয়া, তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। আরও স্পষ্ট করে যদি বলা হয়, সংকট ঘনিয়ে আসছে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানির ভাগ্যাকাশে।

একদিকে পরমাণু চুক্তি সম্পাদন না হলে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার খড়গ উঠবে না, অন্যদিকে সম্পাদিত হলে অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে শুরু হবে দ্বন্দ্ব। সব মিলিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক ক্রান্তি লগ্নে দাঁড়িয়ে আছে ইরান।

১৯৯৬ সাল থেকে ইরানের বিরুদ্ধে পরমাণু কর্মসূচি পরিচালনার অভিযোগ করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিরোধী নীতির রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও নিরব থেকে এক্ষেত্রে বলা চলে একই সুরে গান গাইল রাশিয়াও। আর তাদের সঙ্গে যোগ দিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও চীন। পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও অপর পরাশক্তি জার্মানি একমত হওয়ায় ২০০৬ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ১৬৯৬ নম্বর রেজ্যুলেশন পাশ করে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আর ২০১২ সালে দেশটি থেকে তেল ক্রয়ের ওপর দেওয়া হয় নতুন নিষেধাজ্ঞা। ফলে বিশ্ববাজারে ডলারের বিপরীতে ইরানের মুদ্রা ‘রিয়ালের’ মান যায় কমে। আর আন্তর্জাতিক বাজার ছোট হয়ে আসায় সংকট তো আগে থেকেই ছিল। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ধসের মুখে পড়ে দেশটি।

পরমাণু চুক্তির প্রাথমিক পর্ব সফল হওয়ায় দেশটির জনতার উল্লাসে ফেটে পড়ার দৃশ্য দেখলেই পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বোঝা যায়। আলোচনার প্রাথমিক পর্ব শেষ হওয়ার ডেডলাইন ছিল ৩১ মার্চ। সুইজারল্যান্ডের লুসান শহরে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক চলছিল। নির্ধারিত সময়ের দুই দিন পর ২ এপ্রিল সমঝোতায় পৌঁছান নেতারা। এ ঘোষণা যখন আসে, তখন ইরানে মাঝরাত। সেই মাঝরাতেও জনতা রাজপথে নেমে আসে উল্লাস করতে। তেহরানের রাজপথে গাড়ি চালকরা একটানা হর্ন বাজিয়ে আনন্দ উদযাপন করেন। স্থানীয় সময় রাত ১টার সময়ও রাজধানীর সবচেয়ে বড় সড়ক ভাল-ই-আসরে লেগে থাকে বিশাল যানজট। সেই সঙ্গে রাজপথে থাকা নারী-পুরুষের বেশিরভাগই ইরানের জাতীয় পতাকা হাতে ‘জয়সূচক’ চিহ্ন দেখাতে থাকেন। আলোচনা সফল হওয়া প্রসঙ্গে ‘শীত শেষ’ লেখা একটি পোস্ট ইরানের সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে।

৩৪ বছর বয়স্ক তেহরানের বাসিন্দা আলি সংবাদমাধ্যমকে সেসময় বলেন, এই সফলতা আমাদের জীবনে নতুন আশার সঞ্চার করবে। এর আগের পরিস্থিতিটা এমন ছিল, যেন কেউ আমার শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থাটাকেই রুদ্ধ করে রেখেছিল। এখন আমরা শ্বাস নিতে পারবো। সবাই খুশি। এই সময়টার জন্য আমরা অনেকদিন অপেক্ষা করেছি।

এখন চলছে পরমাণু আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব। গত ২১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে এ পর্ব। বেশ কিছু বিষয়ে এখনও সমঝোতা বাকি আছে বলে আলোচনা চলছে। আগামী ৩০ জুনকে এ পর্বের ‘ডেডলাইন’ ধরা হয়েছে। বর্তমানে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রেও সময় বাড়নো হতে পারে বলে জানা গেছে। এজন্য শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে চুক্তির কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে সোমবার (২৯ জুন) তেহরান ফিরে গেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জাফরি।

চুক্তিটি সম্পাদিত হলে ১০ বছরের জন্য ইরানকে তার স্পর্শকাতর পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা ১৯ হাজার থেকে কমিয়ে ৬ হাজারে নামিয়ে আনতে হবে ও ইউরেনিয়ামের মজুদ কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়া চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই পরিদর্শক দলকে একবার করে ইরানের সামরিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের সুযোগ দিতে হবে।

পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করলে মনে হবে নিষেধাজ্ঞার অভিশপ্ত অধ্যায়ের সমাপ্তির পথে ‌এগিয়ে চলেছে ইরান। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নিষেধাজ্ঞার খড়গ উঠে যাওয়ার জন্য যে চুক্তির পেছনে ছুটছেন খামেনি ও রোহানি, সেই চুক্তির সফলতাই তাদের রাজনৈতিক জীবনে তুলতে পারে এমন ঝড়, যে ঝড়ে উড়ে যাবেন তারা নিজেরাই।

গত ৫ এপ্রিল স্থানীয় সময় রাতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এক সাক্ষাৎকারেই বোঝা যায়, চুক্তি সম্পাদিত না হলে কি ঘটতে পারে। তিনি যদিও চুক্তি পরবর্তী শর্ত ভঙ্গের ব্যাপারে বলেছেন, চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর তা লঙ্ঘন করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইরানে সামরিক অভিযানের পদক্ষেপ নিতেও পিছপা হবে না ওয়াশিংটন।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ হুমকি চুক্তি স্বাক্ষর করে না মানার ব্যাপারে দেওয়া হলেও চুক্তি না হলেও এমনটা ঘটতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আসলে প্রচ্ছন্নভাবে দেশটিকে সুবোধ বালকের মতো আচরণ করার উপদেশ দিয়েছেন।

এবার আসা যাক ইরানের জাতীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে। ১৯৮৯ সালে দেশটির সাবেক সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির স্থলাভিষিক্ত হন বর্তমান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। ইরানের বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী, আইন ও নির্বাচনে প্রার্থীর বৈধতা ঘোষণা দানকারী অভিভাবক কাউন্সিল, জনসম্প্রচার ও অর্থনীতির অনেকাংশেই সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার সিদ্ধান্তই সর্বশেষ বলে গণ্য করা হয়।

সিংহাসনে আরোহনের পর অবস্থান ঠিক রাখতে খামেনি নিজের রাজনৈতিক জোটকেও ততোটা শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ দেননি। এদিকে, নিষেধাজ্ঞার খড়গে পড়ে দেশের চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে পরমাণু চুক্তির বিষয়ে তিনি সবসময়ই সায় দিয়ে এসেছেন প্রেসিডেন্ট রোহানির সব প্রচেষ্টাতে। তবে সাবধানী খামেনি কখনোই চাইবেন না, দেশে এমন কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক, যিনি তার সিংহাসনকে টলিয়ে দিতে পারেন। এ কথার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন দেশটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেই শীর্ষ নেতৃত্ব কখনো কাউকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করতে দেননি। তিনি সব ধরনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তিনি শুধু ইরানের স্বার্থেই কাজ করেন।

এদিকে বিশ্লেষকদের ধারণা, রোহানি খামেনির স্নেহধন্য ততক্ষণই থাকবেন, যতক্ষণ তিনি হুমকি হয়ে দেখা না দেবেন। তবে পরমাণু চুক্তিটি সম্পাদিত হলে রোহানি হয়ে উঠবেন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেকগুণ বেশি জনপ্রিয়, যা নিশ্চিতভাবে প্রভাব ফেলবে ২০১৬ সালের সংসদ নির্বাচনে। বলা চলে, এ নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লব ঘটবে। ফলে ইরানের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো একক দল সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদ থেকে সর্বস্তরে নিজের শাসন কায়েম করার সুযোগ পাবে। এ ঘটনা খামেনির জন্য মোটেই সুখকর হবে না। নির্বাচনে তার চাওয়া থাকবে রোহানি বর্তমানের চেয়ে এক বিন্দু বেশি শক্তির অধিকারী যেন না হোন।

বিশ্লেষকদের একজন সাঈদ লেইলাজের মতে, এর অর্থ চুক্তি সফল হলে আগামী সংসদ নির্বাচন হয় খামেনির পতন দেখবে ইরানবাসী, না হয় অতি সাবধানী খামেনি ডেকে আনবেন রোহানির পতন।

অপর এক বিশ্লেষক মনসুর মার্ভির মতে, চুক্তি সম্পাদন হওয়া মানে খামেনি-রোহানির মধুচন্দ্রিমার শেষ। অর্থাৎ দেশের রাজনীতির আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা।

সব দিক বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, পরমাণু চুক্তিকে যতো মধুরই মনে হোক না কেন, দিন শেষে তা উভয় সংকট হয়েই দেখা দিতে পারে খামেনি ও রোহানির রাজনীতিতে।

বাংলাদেশ সময়: ০২৫২ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।