ঢাকা: অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিই মনে করেন, সমস্যা সৃষ্টিকারীই একটা সময় সমস্যার কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কথাটা ধ্রুব সত্যে পরিণত করতেই হয়তো গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের উৎপত্তি।
একশ ঘণ্টারও কম সময় বাকি গ্রিসে গণভোট অনুষ্ঠানের। আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের দেওয়া শর্তে বেলআউট চুক্তি সম্পাদন করা হবে কি না, সে বিষয়ে জনগণের রায় নিতে স্থানীয় সময় ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এই গণভোট। প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপরাস ও তার সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছেন ‘না’ ভোট আদায়ের। সহজ কোনো শর্তে ঋণদাতাদের সঙ্গে চুক্তির পথ খুঁজতেই এই সিদ্ধান্ত।
গ্রিসের বর্তমান ঋণ ৩২০ বিলিয়ন ইউরো (২৭ লাখ ৮১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকার কিছু বেশি)। এর বেশিরভাগই ইউরোজোন সরকারগুলোর কাছ থেকে নেওয়া। নির্ধারত সময় ৩০ জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রথম কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় ঋণখেলাপের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে দেশটি। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও (ইসিবি) নতুন করে আর জরুরি তহবিল সরবরাহ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সব দেখে মনে হচ্ছে, পুরোপুরি ধসে পড়তে চলেছে গ্রিসের অর্থনীতি।
বিশ্লেষকদের মতে, গ্রিসের বর্তমান অবস্থার জন্য ইউরোজোনভুক্ত দেশগুলোর অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’ই দায়ী। ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি চালু হয় এই মুদ্রা। সহজভাবে যদি বলা হয়, ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার আগে ঋণদাতারা গ্রিসকে মধ্য আয়ের একটি দেশ হিসেবে দেখতো। ফলে এখানে অতিরিক্ত অর্থলগ্নিকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতো। কিন্তু ইউরোজোনভুক্ত হওয়ার পর ঋণদাতারা গ্রিসকে আর বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেনি। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দিতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে দিনে দিনে জমতে থাকে তাদের ঋণের বোঝা। আর এই বোঝাই আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে গ্রিসকে।
অনেকে ভাবতে পারেন যে, ঋণের মাধ্যমে অর্থলগ্নি বাড়লে গ্রিসের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার কথা। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় আয় কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার কথা। এতে এতোদিনে ঋণখেলাপি নয়, ঋণদাতা রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কথা দেশটির। কিন্তু এক্ষেত্রে গ্রিসের ভাগ্যাকাশে খলনায়ক হিসেবে দেখা দিয়েছে ‘ইউরো’।
সমস্যার শুরুটা হয়েছিল গ্রিসের ইউরোজোনে প্রবেশের পরপরই। সেসময় ঋণদাতারা ভাবলো, দেশটি আর মধ্য আয়ের দরিদ্র রাষ্ট্র নেই। কাজেই তারা জার্মানিকে যে সুদে ঋণ দেয়, সেই হারে গ্রিসকেও দেওয়া শুরু করলো। আর ঋণ পেতে হলে ওই হার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না দেশটির সরকারের সামনে। কারণ একটাই, তার মুদ্রাও তখন ইউরো। ফলে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ায় ও ইউরোজোনভুক্ত হওয়ায় শ্রমবাজারে মজুরির পরিমাণ বাড়াতে হলো। ফলে খুব দ্রুতই বাণিজ্য ঘাঁটতি দেখা দেয় দেশটিতে। ১৯৯৯ সালে বাণিজ্য ঘাঁটতি যেখানে দেশটির জিডিপি’র ৫ শতাংশেরও কম ছিল, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এসে তা বেড়ে দাঁড়ালো জিডিপি’র ১৫ শতাংশে। সেই সঙ্গে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অর্থনীতিতে অব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্টদের অসততা সরকারের ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়।
একদিকে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে, অন্যদিকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যয় কমাতে গ্রিসে ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন-ভাতা কমিয়ে দেওয়া হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জাতীয় আয়ে। খরচ কমাতে যে উদ্যোগ, তার প্রভাবে আশঙ্কাজনক হারে কমে যায় উৎপাদন। ফলে তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে কর্মী ছাঁটাই ছাড়া বাকি সব পথ বন্ধ হয়ে যায় সরকারের সামনে। শত শত মানুষ বেকার হতে শুরু করে। একদিকে সদ্য চাকরিতে ঢোকার উপযোগী বেকার তরুণ সমাজ, অন্যদিকে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়ে নব্য বেকার। গত ৩০ জুনের হিসাবে, বর্তমানে গ্রিসে বেকারত্বের হার ২৬.৫ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ বেকারত্বের শিকার হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি।
বেকারত্ব সমস্যার পর গ্রিসের দুর্যোগের জন্য অন্যতম দায়ী সরকারের কর আদায়ে ব্যর্থতা। বর্তমানে দেশটির জাতীয় ঋণ তার জিডিপি’র ১৭৭ শতাংশ। অথচ আপামর জনগোষ্ঠীর কর আদায়ে রয়েছে অমনযোগিতা। বিশেষ করে, ধনী নাগরিকদের মধ্যে কর দেওয়ায় কোনো প্রবণতাই পরিলক্ষিত হয় না। তার ওপর গ্রিসের জটিল কর ব্যবস্থাও জনগণকে কর দিতে নিরুৎসাহিত করে বলে মত বিশ্লেষকদের। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করার ব্যাপারে জনগণকে আগ্রহী করে তুলতে ও পর্যটকদের আকর্ষণ করতে গ্রিসের একটি নিম্ন কর ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু দেশটির যেসব জনগণ কর দেয়, তারা আইনের ফাঁক গলে এই নিম্ন কর ব্যবস্থারই সুবিধা নিয়ে থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, কর ফাঁকি দেওয়াদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও নিরাপত্তা সংস্থার ব্যর্থতা।
গ্রিসের সংকটের অপর একটি কারণ এর পেনশন ব্যবস্থা। ২০১২ সালের ইউরোস্ট্যাট তথ্য অনুযায়ী, দেশটির জিডিপি’র সাড়ে ১৭ শতাংশ খরচ হয় পেনশনখাতে। অথচ ইতালি, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলোয় এ খরচ ১৫ শতাংশের বেশি নয়। এই বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থব্যয়ও দেশটিকে ধসের মুখে ঠেলে দিয়েছে বলে অর্থনীতিবিদদের মত।
ইউরোজোনে ঢোকার পরপরই গ্রিক সরকার ঘোষণা দেয়, উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধির জন্য দেশে বেসরকারিখাতকে উৎসাহিত করা হবে। সরকারের সেসময় লক্ষমাত্রা ছিল সম্পত্তি বিক্রি করে কমপক্ষে ৫০ বিলিয়ন ইউরো (৪ লাখ ৩১ হাজার ২৬ কোটি টাকা) আয় করা। কিন্তু সাড়া না পাওয়ায় পরবর্তীতে তা কমিয়ে প্রথমে ৩০ বিলিয়ন ও আরও পরে ২০ বিলিয়ন ইউরোয় নামিয়ে আনা হয়। সরকারের এ লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ইউরো (২৫ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা) আয় করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অথচ এ লক্ষ্যমাত্রা ক্রমবর্ধমান ঋণের কথা মাথায় রেখেই নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সঠিকভাবে বেসরকারিখাতকে উৎসাহিত করতে না পারায় ঋণের বোঝা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা পরিশোধের পথ হয়ে হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ।
এরপরও হয়তো খুব একটা সমস্যা ছিল না গ্রিসের সামনে। কিন্তু ২০১০ সালে সংকট প্রকট হওয়ার সময় চরম অযোগ্যতার পরিচয় দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রিউ। তিনি এবং তার পরবর্তী গ্রিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা এই সঙ্কটকে আরও ঘণীভূত করে।
** গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসেই কি অবসান ইউরো যুগের?
বাংলাদেশ সময়: ০১০১ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৫
আরএইচ/আরআই