ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অস্থিরতার গ্রাসে গ্রিস

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৫
দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অস্থিরতার গ্রাসে গ্রিস ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই গ্রিসে শুরু হবে গণভোট। নতুন বেলআউট চুক্তি সম্পাদন করা হবে কি না, সে বিষয়ে জনগণের রায় জানতে ৫ জুলাই এ নির্বাচনের আয়োজন করেছে প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপরাসের সরকার।

তবে মত দেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে ভোটাররা। ভোট পূর্ববর্তী জরিপগুলো জানাচ্ছে, ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ ভোটের পক্ষে জনমত খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে।

কয়েকটি সংস্থার পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, নতুন বেলআউট চুক্তি সম্পাদন করার পক্ষে নিজের রায় দিতে চাইছেন ৪১.৫ শতাংশ ভোটার। আর ‘না’ ভোটের পক্ষে রায় দিতে মনস্থির করেছেন ৪০.২ শতাংশ ভোটার। এছাড়া দ্বিধায় রয়েছেন ১০.৯ শতাংশ ভোটার। আর কোনো পক্ষেই রায় দেবেন না বলে স্থির করেছেন ৭.৪ শতাংশ ভোটার। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্বিধান্বিত ভোটাররাই শেষ পর্যন্ত গণভোটের ফল নির্ধারণ করবে।

প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি সিপরাস ও তার দল সিরিজা জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন ‘না’ ভোট আদায়ে। জনগণের রায় এ পক্ষে গেলে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) ও ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সহজ শর্তের সন্ধানে সিপরাস নতুন করে আলোচনায় বসতে পারবেন। এতে করে দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন ও পরিচালনা আরও সহজ হবে বলেই তার মত।

তবে বিরোধী জোট বলছে, যদি ‘না’ ভোট জয়যুক্ত হয়, তাহলে গ্রিস ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে যাবে। এতে করে দেশের ধসে পড়া অর্থনীতিকে আর কখনোই পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হবে না। আর কমিউনিস্ট পার্টি কেকেই’র মত, ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’- উভয় অবস্থানই গ্রিসকে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে।

আসলে ‘ইউরোজোন’ গ্রিসের জন্য এক উভয় সংকটের নাম। এর থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা এর মধ্যে থাকা, কোনোটাই মঙ্গলজনক নয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রিসের জনগণ যে পক্ষেই তাদের রায় দিক না কেন, দেশটির অর্থনীতিতে এ গণভোটের ফলাফল ব্যাপক প্রভাব ফেলতে চলেছে। যদি নতুন বেলআউট চুক্তির পক্ষে নির্বাচনের ফল যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের দেওয়া শর্তই মেনে নিতে হবে অ্যালেক্সিস সিপরাসকে। এর অর্থ, দেশে পেনশন কাঠামো পুনর্নির্ধারণ, কর বৃদ্ধি ও শ্রমবাজার সংস্কার করতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশ কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে।

এমনিতেই চলমান সংকট থেকে উত্তরণে ২০১০ সালের পর থেকে গ্রিসে বেতন-ভাতা ২০ শতাংশ কমানো হয়েছে। সেই সঙ্গে চলেছে কর্মী ছাঁটাই। ফলে দেশটিতে এখন বেকারত্বের হার ২৬.৫ শতাংশ। শ্রমবাজারে সংস্কার করতে হলে দেশটিতে প্রাথমিকভাবে বেকারত্বের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে পেনশন কাঠামোতে পরিবর্তন আনলে ও কর বৃদ্ধি করলে নিশ্চিতভাবে দেশটিতে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের হার বেড়ে যাবে ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঘটবে। ফলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হবে।

এমন পরিস্থিতিতে যারা প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপরাসের যুক্তি মেনে নিয়ে ‘না’ ভোট দেবেন বলে মনস্থির করেছেন, তারাও যে খুব একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আছেন, তা মনে করছেন না অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে সমস্যা উল্টো আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে। গ্রিসের সরকার ও জনগণের শক্ত অবস্থানের প্রেক্ষিতে সহজ শর্তে নতুন বেলআউট চুক্তিতে সম্মত নাও হতে পারে আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা। সেক্ষেত্রে ইউরোজোন থেকে ছিটকে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে দেশটির।

বর্তমানে গ্রিসের মোট ঋণ ৩২০ বিলিয়ন ইউরো (২৭ লাখ ৮১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকার কিছু বেশি)। এর বেশিরভাগই ইউরোজোনের সরকারগুলোর কাছ থেকে নেওয়া। এর মধ্যে প্রথম কিস্তি পরিশোধের শেষ তারিখ চলে গেছে গত ৩০ জুন। পরবর্তী তিনটি কিস্তি পরিশোধ করতে সামনে আসছে আরও তিনটি তারিখ। আগামী ১০ জুলাইয়ের মধ্যে ২ বিলিয়ন ইউরো (১৭ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা প্রায়), ২০ জুলাইয়ের মধ্যে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ইউরো (৩০ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা প্রায়) মূল্যমানের বন্ড ও ২০ আগস্টের মধ্যে ৩.২ বিলিয়ন ইউরো (২৭ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার কিছু বেশি) মূল্যমানের বন্ড পরিশোধ করতে হবে দেশটিকে। এসব ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে গ্রিস নিশ্চিতভাবে ঋণখেলাপি হয়ে ইউরোজোন থেকে ছিটকে পড়বে।

ইউরোজোন থেকে ছিটকে পড়লে প্রথমেই মুদ্রা সংকটে পড়তে হবে দেশটিকে। ইউরোজোনে প্রবেশের আগে দেশটির মুদ্রা ছিল ড্রাকমা। তবে অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’-কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মুদ্রা হিসেবে নেওয়ার পর ২০০১ সালে নিজস্ব মুদ্রার বিলুপ্তি ঘটায় গ্রিস। এতে করে দেশটিতে ইউরো বাতিল হয়ে যাওয়া মাত্র জনসাধারণের ব্যক্তিগত ও ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ সাময়িক সময়ের জন্য অচল হয়ে পড়বে।

অর্থাৎ যতোক্ষণ পর্যন্ত সরকার নতুন মুদ্রা ছাপানোর ব্যবস্থা না করবে, ততক্ষণ কাগজে-কলমে অর্থ থাকলেও তা ব্যবহার করতে পারবে না গ্রিসের জনগণ। তবে পুরনো মুদ্রা ড্রাকমা বা নতুন কোনো মুদ্রা প্রচলন যে সহজ হবে না, তা এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন গ্রিসের অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারৌফাকিস।

অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক রেডিও নেটওয়ার্ক এবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, নিজস্ব মুদ্রা ছাপানোর সামর্থ্য নেই আমাদের। ইউরোকে মুদ্রা হিসেবে নেওয়ার পর আমরা নিজস্ব টাকশাল ধ্বংস করেছি। বর্তমানে আমাদের কোনো টাকশাল নেই।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, যদি কোনোভাবে নিজস্ব মুদ্রার ব্যবস্থা করেও ফেলে সরকার, তবু সংকট কাটবে না। এ ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করে গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টোনিস সামারাস বলেছেন, ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে গেলে জনসাধারণের জীবনমানের অবনতি ঘটবে ৮০ শতাংশ।

ড্রাকমা কিংবা নতুন কোনো মুদ্রা, যেটাই প্রচলন করা হোক না কেন, সরকারকে দ্রুত তা ছাপানোর উদ্যোগ নিতে হবে ও দেশে যতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আছে, তা দ্রুত ইউরো থেকে নতুন মুদ্রায় স্থানান্তরিত করতে হবে। এদিকে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে জরুরি অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। ইউরোজোন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এর থেকে আর কোনো সহায়তা পাওয়ার আশা থাকবে না। ফলে দ্রুত গ্রিসের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। যতো দ্রুত ব্যাংকটি সক্রিয় হবে, ততো দ্রুত সরকার তার নতুন মুদ্রাকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিতে পারবে।

অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, নতুন মুদ্রা প্রচলনের পর মুদ্রাস্ফীতির হার ৪৫ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। হঠাৎ এই অর্থনৈতিক ধস গ্রিসকে একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০১৫
আরএইচ/আরআই/টিআই

** ইউরোই গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসের কারণ
**  গ্রিসের অর্থনৈতিক ধসেই কি অবসান ইউরো যুগের?

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।