ঢাকা: বিশ্ব রাজনীতিতে বর্তমানে যে ইস্যুগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, তার অন্যতম ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির পরমাণু আলোচনা। একদিকে দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞার খাড়া কাটিয়ে ইরান সরকার ও তার জনগণের সামনে নতুন দিনের হাতছানি, অন্যদিকে সৌদি আরব ও ইসরায়েলসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
এখন ভিয়েনায় চলছে পরমাণু আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব। গত ২১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানির সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের এ বৈঠক শুরু হয়। এ পর্বে সমাধানে পৌঁছাতে সবগুলো পক্ষের স্বপ্রণোদিত ডেডলাইন ৩০ জুলাই থাকলেও তা পরবর্তীতে বাড়ানো হয়।
ভিয়েনায় এক কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সম্প্রতি জানিয়েছে, বর্তমানে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও ব্যালাস্টিক মিসাইল নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে দর কষাকষি চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, চুক্তি সম্পাদন হলেও এখনই অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে না ইরানের ওপর থেকে। আরও অন্তত দুই বছর বলবৎ থাকতে পারে এ নিষেধাজ্ঞা। আলোচনা সাপেক্ষে তা আট বছর পর্যন্তও বাড়ানো হতে পারে। তবে ইরান চাইছে, চুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গেই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি তুলে নেওয়া হোক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রবেশে সব ধরনের বাধা।
চলতি বছর ২৪ নভেম্বর পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের ‘ডেডলাইন’ হিসেবে নির্ধারণ করেছে আলোচনায় অংশ নেওয়া সবগুলো পক্ষ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, চুক্তি সম্পাদিত হলে ইরানকে অন্তত ১০ বছরের জন্য তার স্পর্শকাতর পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা ১৯ হাজার থেকে কমিয়ে ৬ হাজারে নামিয়ে আনতে হবে আর ইউরেনিয়ামের মজুদ কমিয়ে আনতে হবে।
এছাড়া চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পূর্ব শর্ত হিসাবে, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই পরিদর্শক দলকে একবার করে ইরানের সামরিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের সুযোগ দিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত অভিযোগের মুখে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ২০০৬ সালে পাশ হয় ১৬৯৬ নম্বর রেজ্যুলেশন। এই রেজ্যুলেশনের বলে ইরানের ওপর সেসময় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ২০১২ সালে এসে দেশটি থেকে তেল ক্রয়ের ওপর দেওয়া হয় নতুন আরেক নিষেধাজ্ঞা। এতে ইরানের জন্য সীমিত হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক বাজার। অর্থনৈতিক ধসের মুখে পড়ে দেশটি। বেকারত্বের ছোবলে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে এর সরকার ও জনগণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান এখন শুধুমাত্র তেল রপ্তানিখাতে একশ বিলিয়ন ডলারের (৭ লাখ ৭৬ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা প্রায়) মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেকের মতে এ হিসাবটা ১২৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সেই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার খাড়া উঠে গেলে ইউরোপজুড়ে ইরানের ব্যাংকিং ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তার সঙ্গে যোগ হবে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ। ফলে ইরানের অর্থনীতির আকার ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে।
এদিকে, অনেকটা একই কারণে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সৌদি আরব ও ইসরায়েল। পরমাণু চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে নিরুৎসাহিত করতে মার্কিন কংগ্রেস পর্যন্ত গেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ইরানকে এ চুক্তির মাধ্যমে পরমাণু কর্মসূচি থেকে বিরত রাখা তো যাবেই না, উল্টো আরও সুযোগ করে দেওয়া হবে। আর এর ফলে দেশটি গাজা, লেবানন ও ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সহিংসতা ছড়ানোর সুযোগ পাবে। সেই সঙ্গে ইসরায়েলি নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠবে ইরান।
কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার সময় ইরানকে ‘বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি’ আখ্যা দিয়ে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইরানের সমর্থনেই সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সেখানকার অধিবাসীদের হত্যা করছে, শিয়া মিলিশিয়ারা ইরাকে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে, লোহিত সাগরীয় অঞ্চলে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের নিজস্ব নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ার মূল কারণ আসলে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক। ইসরায়েল তার যুক্তিতে যতোই বলুক, বাশার আল-আসাদ ইরানের সমর্থনপুষ্ট, কিন্তু সৌদি আরবসহ বাকি সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছে, ইরানের অবস্থান আসলে সিরীয় প্রেসিডেন্টের বিপক্ষেই। বাশার আল-আসাদ ও ইসলামিক স্টেট (আইএস) ইস্যুতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র একই মত পোষণ করে। কাজেই ক্রমেই এ দুই দেশের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা ইসরায়েলের। ফলে পরবর্তীতে ইরান কখনও ইসরায়েলের বিরোধিতা করে বসলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরবতা পালন অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনা হবে না।
অনেকটা একই কারণ দেখিয়ে সৌদি আরবও ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও, এ চুক্তির ফলে দেশটি তার অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি। তার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারে দুই দেশের দ্বন্দ্বও এ আশঙ্কার আগুনে যুগিয়েছে জ্বালানি।
সৌদি আরবের বিরোধিতার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রথমেই রাখছেন আন্তর্জাতিক বাজার প্রসঙ্গ। বর্তমানে অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে রাশিয়ার পরই সৌদি আরবের অবস্থান। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) ২০১২ সালে এক হিসাবে জানায়, দিনে গড়ে ১ কোটি ১ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করে রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশ। এরপরই দিনে ৯৭ লাখ ৩৫ হাজার ব্যারেল তেল উৎপাদন করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সৌদি আরব। ইউক্রেন ইস্যু ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধের কারণে তেল উৎপাদনে শীর্ষে থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি রাশিয়া। এক্ষেত্রে আধিপত্যের বিচারে সৌদি আরব শীর্ষে। কিন্তু ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে সৌদির এই একচেটিয়া বাজারে ভাগ বসতে পারে। আইইএ’র হিসাবে, ২০১২ সালে ইরানের দিনপ্রতি তেল উৎপাদনের হার ছিল ৩১ লাখ ১৩ হাজার ব্যারেল।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ৫০ ডলার। পরিস্থিতি ভেদে এ দাম কিছু কম বা বেশি হলেও তা খুব একটা প্রভাব ফেলে না সৌদির বাণিজ্যে। কিন্তু ইরান বিশ্ববাজারে আসলে তেলের দাম কমে ব্যারেল প্রতি ২০ ডলার পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। দামের এ পতন সৌদির অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছে দেশটি।
সৌদি আরব ও ইসরায়েলের আরও বড় আশঙ্কা, পরমাণু কর্মসূচি এই মুহূর্তে স্থগিত রাখা গেলেও ১০ বা ১৫ বছর পর এ নিষেধাজ্ঞা ঠিকই উঠে যাবে ইরানের ওপর থেকে। ততোদিনে দেশটি তার বর্তমান দুর্দশা কাটিয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। কাজেই তখন ইরান আবার তার পরমাণু কর্মসূচি শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ভিন্ন মতের ইরান ও সৌদি আরব আধিপত্য বিস্তারে বহুকাল আগে থেকেই সোচ্চার। নিষেধাজ্ঞার কারণে সমস্যা জর্জরিত হয়ে পড়ায় ইরান ক্ষমতার রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়লেও পুরোপুরি অনুপস্থিত কখনোই ছিল না। সম্প্রতি ইয়েমেনে সংঘর্ষে লিপ্ত শিয়াপন্থি হুথি বিদ্রোহীদের ব্যাপারে পর্যালোচনা করলেই এ তথ্যের সত্যতা মিলবে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে শিয়া মুসলিমদের ভেতর গ্রহণযোগ্যতা থাকায় বিভিন্নভাবেই এই অঞ্চলের রাজনীতিতে বড় একটা ফ্যাক্টর ইরান। অর্থনৈতিক মুক্তি আসলে দেশটি যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে, সে আশঙ্কা কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছে না এই অঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলো।
বাংলাদেশ সময়: ০৩০৩ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৫
আরএইচ
** পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে উভয় সংকটে খামেনি-রোহানি