ঢাকা, বুধবার, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ভূমিকম্পের তিন মাস পরও ধ্বংসস্তূপে বন্দি নেপাল

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৫
ভূমিকম্পের তিন মাস পরও ধ্বংসস্তূপে বন্দি নেপাল ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ২০১৫ সাল। অন্য সাধারণ বছরগুলোর মতো এই বছরটিও হিমালয়কন্যা নেপালের ইতিহাসে সাধারণের খাতাতেই জমা পড়তে পারতো।

কিন্তু এ বছরের ২৫ এপ্রিল ও ১২ মে’র ভূমিকম্প দেশটিকে পরিণত করে মৃত্যুপুরীতে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটি মাস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও ধ্বংস্তূপের কারাগার থেকে মুক্তি মেলেনি নেপালের।

চলতি বছর ২৫ এপ্রিল রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রায় কেঁপে ওঠে নেপাল। এর ঠিক সতের দিনের মাথায় ১২ মে আবারও এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে দেশটিতে। রিখটার স্কেলে এদিনের ভূকম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৪। এ দুই ভূমিকম্প ছাড়াও সাড়ে তিন শতাধিক পরাঘাত মৃত্যুপুরী নেপালকে করে তুলেছে আরও বেশি ভয়ংকর।

‌সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শক্তিশালী দুই ভূমিকম্পের আঘাতে নেপালে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৯ হাজার মানুষের। আট দশকের মধ্যে এবারের ভূমিকম্পেই মৃত্যুর মিছিল এতোটা ব্যাপক। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০ হাজার মানুষ। সেই সঙ্গে আট লাখের বেশি বাড়িঘর ও স্থাপনা আংশিক অথবা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, দেশটির মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২৮ লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।

কেন এই ভূমিকম্প, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা নতুন কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক রজার বিলহাম ও ইউনিভার্সিটি অব মন্টানার ভূতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেবেকা বেন্ডিকসহ বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, লক্ষ-কোটি বছর আগে যে কারণে হিমালয় পর্বতমালার জন্ম হয়েছিল, ঠিক একই কারণে চলতি বছরের ভূকম্পন। ভূস্তরের ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটনিক প্লেটের সন্ধিস্থলের ওপর অবস্থিত নেপাল। আর একারণে প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এই দুই প্লেটের সংঘর্ষেই জন্ম হয়েছিল হিমালয়ের।

প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের আঘাতের পর তিন মাস কেটে গেছে। কেমন আছে হিমালয়কন্যা নেপালের মানুষ? বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিচালিত জরীপ ও গবেষণা বলছে, আশ্রয় ও নিরাপত্তাহীনতা, খাদ্য, চিকিৎসা, সুপেয় পানি ও পয়নিষ্কাশনের অভাবে ধুঁকছে দেশটির আপামর মানুষ।

সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারনেশনাল, ইউনিসেফ ও ওয়ার্ল্ড ভিশন দুই সহস্রাধিক শিশুর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। প্রায় সব শিশুর ক্ষেত্রেই নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি সবার আগে উঠে এসেছে। একদিকে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে গিয়ে বন্যপশুর আক্রমণ, অন্যদিকে মেয়ে শিশুদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিল করে তুলছে।

১৭টি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নিরাপত্তাহীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত সব বয়সের নারীই শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যেসব আশ্রয় কেন্দ্রে জনঘণত্ব বেশি, সেসব স্থানে এ নির্যাতনের হার বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত দশক পরও যেমন হিরোশিমা ও নাগাসাকির মানুষ তার চিহ্ন বহন করে চলেছে, একইভাবে প্রাণঘাতী এই ভূমিকম্পের চিহ্ন বহন করতে হবে নেপালের জনগণকেও। এর অন্যতম কারণ শিশুদের ওপর এর শারীরিক ও মানসিক ব্যাপক প্রভাব। এছাড়া গর্ভবতী নারীদের অনাগত সন্তানদের ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অভিজ্ঞমহল। এক হিসাবে জানা গেছে, ভূমিকম্পে দেশটির ১ লাখ ২৬ হাজার গর্ভবর্তী নারী আক্রান্ত হয়েছেন। সঠিক পরিচর্যা ও খাদ্যাভাবের কারণে বর্তমানে এরা সবই ঝুঁকিতে রয়েছেন।

এদিকে, ভূকম্পনের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই ভারী বৃষ্টি ও ভূমিধসে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নেপাল। দেশটিতে মানবিক সহায়তা দানকারী সংস্থা কেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর লেক্স কাসেনবার্গ জানিয়েছেন, ভারী বৃষ্টিতে এরই মধ্যে নেপালের অনেক দুর্বল সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন করে ভূমিধসের ঘটনা ঘটছে। ফলে একদিকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্গঠন তৎপরতা, অন্যদিকে ধসে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকারের সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।

নেপালের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস কৃষি ও পর্যটন। উভয়খাতেই ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে ভূকম্পনে। চলতি বছর অক্টোবরে নতুন পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ার কথা ‍উল্লেখ করে দেশটির পর্যটন বিভাগের প্রধান তুলশি গৌতম জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে যদি নেপালের পর্যটনকে আবার চাঙ্গা করা না যায়, তাহলে আসছে মৌসুমে দেশের অর্থনীতি আরেকটি বড় ধরণের ধাক্কা খাবে।

সরকারি হিসাবে, নেপাল পুনর্গঠনে ৬.৭ বিলিয়ন ডলার (৫২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা প্রায়) অর্থ প্রয়োজন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী ও বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ৪.৪ বিলিয়ন ডলার (৩৪ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্রায়) সহায়তার আশ্বাস এসেছে। আশ্বাসের বেশিরভাগ অর্থ এরই মধ্যে পৌঁছেও গেছে কর্তৃপক্ষের হাতে।

তবে মানবিক সহায়তা দানকারী সংস্থাগুলোর দাবি, নিজেদের বাড়িঘর পুননির্মানে জনপ্রতি প্রতিশ্রুত ২ হাজার (১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা প্রায়) অর্থ সহায়তা এখনও পাননি নেপালের জনগণ। তাদের হাতে গড়ে ১৫০ ডলার (১২ হাজার টাকা প্রায়) করে অর্থ পৌঁছেছে।

এ বিষয়ে দেশটির অর্থমন্ত্রী রাম শরণ মহত বলেছেন, আমরা সবে নতুন অর্থবছরে প্রবেশ করেছি। ‘দেশ পুণর্গঠন কর্তৃপক্ষ’ শীর্ষক একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে সরকার, যার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।