ঢাকা, বুধবার, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

রামেশ্বরম থেকে শিলং: আলোকের পথে এক মহান যাত্রা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৫
রামেশ্বরম থেকে শিলং: আলোকের পথে এক মহান যাত্রা ২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায় তোলা। ছবি: নাজমুল হাসান / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বাবা ছিলেন নৌকা চালক। অভাবের সংসারে সাত ভাইবোনের জন্য ভাত রাঁধলেও, ছোট ছেলেটার জন্য মা করতেন বাড়তি কয়েকটা রুটি।

ভোর চারটেয় উঠে পড়তে বসবে ছেলেটা। তখন খিদে পাবে।

শুধু তাই নয়, অভাবের সংসারে নামমাত্র পুঁজি থেকে কিনতেন বাড়তি কেরোসিন। কত রাত পর্যন্ত ছেলে পড়াশোনা করবে কে জানে!

এই ছেলে যে অনেক বড় হবে তখন আর কে‍উ না ভাবলেও ঠিক জানতেন মা। স্বপ্ন দেখতেন, বাড়ির খুব কাছেই যে বঙ্গোপসাগর, একদিন সেই বিশাল সমুদ্রও ছাড়িয়ে যাবে তাঁর ছেলের নামডাক।

মায়ের সেই স্বপ্ন সত্যি করেছিলেন আবদুল।   বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে তার নামডাক পৌঁছে গিয়েছিলো সাত সমুদ্রের অপর পারেও। তবে রাস্তাটা নেহাত সোজা ছিল না।

যে বঙ্গোপসাগরের দিকে তাকিয়ে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতেন মা আসিম্মা, সেই সমুদ্রসৈকতেই দু’দশক ধরে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ করে গিয়েছেন তার ছেলে। হয়েছিলেন ভারতের প্রথম বিজ্ঞানী রাষ্ট্রপতি।

মহাকাশ ও পরমাণু গবেষণায় অবদানের জন্য পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ও ভারতরত্নে সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি।

তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে এক অতি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবুল পাকির জয়নুল আবদিন আবদুল কালাম। বাবা জয়নুল আবদিন ছিলেন এক সাধারণ মৎস্যজীবী ও নৌকার চালক। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই রোজগারের তাগিদে খবরের কাগজ বিক্রি করতে হতো আবদুলকে। স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ার জন্য একটা বৃত্তি পান তিনি। ভর্তি হন তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ কলেজে। ১৯৫৪ সালে সেখান থেকেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। তার পর ফের স্কলারশিপ নিয়ে চেন্নাইয়ে। পড়তে শুরু করেন এয়ারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং। তাঁর স্বপ্ন ছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানচালক হবেন। তার ক্লাসের প্রথম আট জনকে বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। কালাম হয়েছিলেন নবম। সে যাত্রায় তাই আর যুদ্ধবিমানের চালক হয়ে ওঠা হয়নি কালামের। তবে নিজের অদম্য চেষ্টায় তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু কর্মসূচির প্রাণপুরুষ।

আগের দিন বিকেলে আসামের গুয়াহাটি এসেছিলেন কালাম। সেখান থেকে সড়কপথে যান শিলং। বিমানবন্দরে গুণমুগ্ধদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথাও বলেন হাশিখুশি কালাম। তার অল্প পরেই খবর আসে এপিজে আবদুল কালাম আর নেই।

শিলংয়ে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে বক্তৃতা রাখার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তিনি।

তার মৃত্যুর খবরে স্তম্ভিত আসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বের সাধারণ মানুষ। তার মৃত্যুর খবরে বেথানি হাসপাতালের সামনে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ।

তরুণ গগৈয়ের কথায়, ‘‘আসাম তথা উত্তর-পূর্বের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা ছিল। বারবার এখানে আসতেন তিনি। ওঁর সঙ্গে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরেছি। এত জ্ঞানী অথচ মাটির কাছাকাছি মানুষ কমই দেখা যায়। ’’

শিলংয়ে এসে কালাম বলেছিলেন, ‘‘কাল ব্রহ্মপুত্রের কাছে গিয়েছিলাম। আমার বড্ড প্রিয় নদ। এই নদের সংস্কার করতে চাই। ’’

ভারতের প্রথম ‘বিজ্ঞানী’ রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম ছিলেন জনগণের ‘রাষ্ট্রপতি’। তিনি ছিলেন সাধারণ ভারতীয়দের অনুপ্রেরণা। এমনকি মৃত্যু পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন কর্মঠ এবং নিয়মানুবর্তিতার উজ্জল দৃষ্টান্ত। ভারতের রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়েও জীবনযাত্রার কিছুই হেরফের হয়নি। তিনি  রাত ১টা পর্যন্ত জেগে থাকতেন, বই পড়তেন, ভক্তদের মেইলের উত্তর দিতেন।

২০০২ সালে ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এপিজে কালাম। রাষ্ট্রপতি ভবনে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। তাঁর সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা সর্বসাধারণ, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্যখুলে দেওয়া হয়েছিল। ছেলে-বুড়ো,বিজ্ঞানী-শিক্ষক সকলের কাছেই তিনি ছিলেন ‘সর্বসাধারণের রাষ্ট্রপতি’।

রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আবার ফিরে যান পড়াশোনার জগতে। শিলং, ইন্দোর ও আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, তিরুঅনন্তপুরমের ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র,  বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে নিয়মিত পড়াতেন। তাই এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মঞ্চেই বক্তৃতা দিতে দিতে তাঁর হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়া, যেন নিয়তির অদ্ভূত খেলা।

দেশ,জাতি ও মানবতার কল্যাণে আত্মোৎসর্গিত এই মহান বিজ্ঞানী ছিলেন অকৃতদার। একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এখনো তিনি অবিবাহিত, এর কারণটা কী? হাসি দিয়ে কালামের উত্তর ‘এই প্রশ্নটা ৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। ভারতে এমনকি ভারতের বাইরেও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি আমি। আমি আগেও উত্তর দিয়েছি তাদের যে আমি যৌথ পরিবার থেকে এসেছি। আমার ভাইয়ের নাতনি রয়েছে। এমন দারুণ পরিবারে একজন বিয়ে করল কি করল না তা খুব একটা বড় বিষয় না। তাছাড়া জীবনে কখনো অর্ধাঙ্গিনীর প্রয়োজন অনুভব করিনি। "

খুব ছেলেবেলাতেই নিজের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন আবদুল কালাম। নিজের লেখা একটি বইয়ে আবদুল কালাম বলেছেন, ছোটবেলায় সমুদ্র সৈকতে পাখিদের উড়াউড়ি দেখে আকৃষ্ট হতেন তিনি। সৈকতের ওই উড়ন্ত পাখি দেখেই জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিলেন তিনি।

পরে ১০ বছর বয়সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক সিভাসুব্রামানিয়া পাখি কীভাবে উড়ে সেই প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছিলেন। একই সঙ্গে বিমান উড়ার পদ্ধতিও জেনেছিলেন। তখনই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন তিনি।

উপমহাদেশের এই পরমাণু বিজ্ঞানীর কথায়, “প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক মুহূর্ত আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক বছরের জানুয়ারি মাসের এক তারিখে সারা বছরের জন্য আমার লক্ষ্য স্থির করে নিই আমি। আর সেই হিসাবেই কাজ শুরু করি। আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি যা পরিকল্পনা করেছিলাম তার ৬০-৭০ শতাংশই অর্জন করেছি। দেখতেই পাচ্ছেন আমার লক্ষ্য কখনও থেমে থাকে না। "

আবদুল কালাম ছিলেন ভারতীয় তরুণ এবং যুব সমাজের পথ প্রদর্শক। গত দু’দশকে তার সান্নিধ্য লাভ করেছে অন্তত ১৬ লাখেরও বেশি ভারতীয় যুবক-যুবতী।

কালামের কথায়, "ভারতীয় যুব সমাজ কর্মঠ এবং পক্ষপাতহীন। সবচেয়ে বড় কথা তাদের মধ্যে সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত ভারতে বসবাস করার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে।

২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন এই বৈজ্ঞানিক দেখেছিলেন তা দেশের যুবকদের একজোট হওয়ার মাধ্যমেই সম্ভব বলে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের উন্নয়নে তার ছিলো নিজস্ব ভিশন ২০২০।

ধর্মের গোঁড়ামি এড়িয়ে চলতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকে মুক্তমনা ছিলেন আবদুলও। গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারতেন ভগবদ্‌গীতা। কোরআন শরীফও। আর সব সময় বলতেন, লেখাপড়ার কোনও বিকল্প হয় না। স্কুলপড়ুয়াদেরও বারবার অনুপ্রাণিত করে বলেছেন, নিজের ভবিষ্যতের কারিগর হতে গেলে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। আর কখনও কাজে ফাঁকি দেবে না। নিজের জীবনেও এ কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছেন। কর্মজীবনে ঠিক দু’দিন ছুটি নিয়েছিলেন, মায়ের আর বাবার মৃত্যুদিনে।

বলে গিয়েছিলেন, ‘‘আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা কোরো না। আমায় যদি ভালবাসো, মন দিয়ে কাজ করো সে দিন। ’’

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৫
আরআই/

** আবদুল কালামের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বৃহস্পতিবার
** ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে হাইকমিশনে শোকবই
** বাসভবনে আবদুল কালামের মরদেহ
** দিল্লি পৌঁছেছে আবদুল কালামের মরদেহ
** আবদুল কালামের সম্মানে বিহার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন
** আবদুল কালামের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তামিলনাড়ুতে

** লন্ডনে নৈশভোজ-বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বাতিল মমতার

** ‘পারলে একদিন অতিরিক্ত কাজ করবে’
** আবদুল কালামের স্মরণে ভারতীয় সংসদে নিরবতা
** আবদুল কালামের শেষ টুইট
** দুপুরে দিল্লি পৌঁছুবে আবদুল কালামের মরদেহ
** আবদুল কালামের সেরা ১০ উক্তি
** দিল্লি নেওয়া হচ্ছে আবদুল কালামের মরদেহ
** আবদুল কালামের যে ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেলো
** টুইটারে আবদুল কালামকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ
** এপিজে আবদুল কালাম আর নেই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।