ঢাকা: গণতন্ত্র পাকিস্তানের পরিবেশের জন্য মানানসই হয়নি বলেই সেদেশের সরকারে প্রায়শই সেনাবাহিনীকে ভূমিকা রাখতে হয়েছে। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ বলেছেন একথা।
“আমাদের স্বাধীনতার পর থেকেই সেনাবাহিনী সবসময়ই ভূমিকা রেখে এসেছে। পাকিস্তানের সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী দেখিয়ে আসছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সবক’টি তথাকথিত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অপশাসনের কারণেই সেনাবাহিনীকে এটা করতে হয়েছে। ”
বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জেনারেল মুশাররফ ওয়াশিংটন আইডিয়াস ফোরামকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন।
মুশাররফ বলেন, “পাকিস্তানের ‘অন্তর্নিহিত দুর্বলতা’ এই যে, দেশটির পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে গণতন্ত্র খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে কোনো নিয়ন্ত্রণ বা ভারসাম্য নেই। দেশের সংবিধানেই এই ভারসাম্য রাখা হয়নি। আর সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে জোর করে টেনে আনা হয়; বিশেষ করে যখন অপশাসন চলতে থাকে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান নামতে থাকে। সাধারণ জনগণ তখন সেনাপ্রধানের কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে যায়। এভাবেই সেনাবাহিনী সরকার ও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ”
পাকিস্তান নামের দেশটিতে কেন বারবার সেনাঅভ্যুত্থান হয়- এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এভাবেই সেনাবাহিনীর অপ-ভূমিকার পক্ষে সাফাই গান ক্ষমতাদখলকারী এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
“পাকিস্তানের মানুষ সেনাবাহিনীকে ভালোবাসে এবং সেনাবাহিনীর কাছে তাদের আবদারও অনেক বেশি। তাই আমি খুবই গর্বিত যে সেনাবাহিনী আমাকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে; কেননা ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। আমি তাদের সঙ্গে নিয়ে দু’দুটো যুদ্ধ লড়েছি। সে কারণেই আমি জানি তারা আমার নিজের লোক। ”
“সুতরাং আমার মনে হয় পাকিস্তানের পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে আমাদেরকে এর রাজনৈতিক কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে, নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য আনতে হবে যেন অপশাসনের পথ বন্ধ হয়, যেন সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে নাক গলাতে ও নামতে না হয়। ’’ বলেন মুশাররফ।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে মুশাররফ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই পাকিস্তানকে নিজের সুবিধামতো ব্যবহার করেছে এবং প্রয়োজন শেষে হেলায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। ”
মাথার ওপর মামলা খগড় থাকার পরও মুশাররফ প্রবাস জীবনের ইতি টেনে নিজের দেশ পাকিস্তানে ফিরতে চান। তার মতে, তার নামে যতো মামলা হয়েছে, সেসবের সবক’টিই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। তবু এসব মামলা তিনি দেশে ফিরে মোকাবেলা করতে চান। তাতে ঝুঁকি আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, “নো রিস্ক, নো গেইন। ”
পাকিস্তানের সরকার যদি ভালোভাবে তার কাজ করতো, যদি সুশাসন থাকতো তাহলে তার আর দেশে ফেরার দরকার হতো না। তবে দেশে ফেরার পেছনে আবার শাসনভার গ্রহণ করার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই বলে দাবি করেন মুশাররফ।
তিনি এই দাবি করলেও আসল সত্য হচ্ছে দেশে ফেরার জন্য আবার কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফবিরোধী একটি প্রভাবশালী অংশ চায় জেনারেল মুশাররফ দেশে ফিরে ভূমিকা রাখুন।
মুশাররফের নিজের কথায়ও এর ইঙ্গিত মেলে, “আমি ততোটা বোকা নই। তাই (ফেরার আগে) আমি উপযুক্ত অনুকূল পরিবেশ দেখতে চাই যেখানে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা, তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। আমি সবকিছু এমন পর্যায়ে রয়েছে দেখতে চাই, যেন আমার চলাফেরায় কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে না। মামলাগুলো চলতে থাকুক। আমি সেগুলো মোকাবেলা করবো। ”
দেশে ফিরে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার ইচ্ছের কথা গোপন করেননি মুশাররফ। অথচ তিনিই আবার দাবি করছেন তার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই।
সাক্ষাৎকারে মুশাররফ বলেন, “আমি চাই আমার চলাফেরায় যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা না হয়। কেননা আমি এটা বুঝতে পারি, আমি যদি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে না পারি তাহলে তৃতীয় ফ্রন্ট গঠন করার মতো প্রয়োজনীয় জনসমর্থন আমি সৃষ্টি করতে পারবো না। ”
এক পর্যায়ে লাদেন প্রসঙ্গেও কথা বলেন মুশাররফ। তিনি দাবি করেন, লাদেন যে পাকিস্তানে বসবাস করতেন এটা তার জানা ছিল না। পাকিস্তানে লাদেনের গোপন আস্তানাকে প্রাসাদ বলারও বিরোধিতা করেন তিনি।
লাদেন যে চার দিকে উঁচু প্রাচীরঘেরা বাড়িতে থাকতেন সেরকম বাড়ি পাকিস্তানে বিস্তর আছে। বাড়িতে প্রাচীর থাকা “স্বাভাবিক ব্যাপার” দাবি করে মুশাররফ বলেন, এ কারণেই লাদেনের প্রাচীরঘেরা বাড়িটিকে কেউ সন্দেহের চোখে দেখেনি।
লাদেন আদৌ অ্যাবোটাবাদের কথিত বাড়িটিতে টানা পাঁচ বছর থেকেছেন কিনা কিনা এ ব্যাপারেই বরং উল্টো সন্দেহ পোষণ করেন মুশাররফ; “হতে পারে তিনি (লাদেন) ওই বাড়িতে স্রেফ আসা-যাওয়া করতেন, আমি এখনো বিশ্বাস করি। ওই বাড়ির একটি ঘরে তিন স্ত্রী ও ১৮ সন্তান নিয়ে যদি তিনি থাকতেনই, তাহলে তিনি নিজেই হয়তো ফোন করে সিআইএ-কে তার অবস্থানের কথা জানান দিয়েছিলেন। ”
পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে ভারত যে সার্জিকাল স্ট্রাইক চালিয়েছে, মুশাররফ ক্ষমতায় থাকলে ভারতে পাল্টা আঘাত হানার হুমকি দিতেনই দিতেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ওরা (ভারতীয়রা) আমাদের হুমকি দিচ্ছে, যখন যেখানে খুশি ওরা আমাদের ওপর হামলা চালাবে। আর এই হুমকিটা আসছে (ভারতের) প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর তরফ থেকে এবং মিলিটারি অপারেশন্স’র ডিজির তরফ থেকে। ব্যাপারটা তাই খুবই গুরুতর। ”
ভারত যুদ্ধের উন্মাদনা ও উস্কানি তৈরি করছে অভিযোগ করে মুশাররফ বলেন, “আমি মনে করি যুদ্ধের যে উন্মাদনা ভারতে তৈরি করা হচ্ছে- আমি আবার বলছি পাকিস্তানে নয়, ভারতে তৈরি হচ্ছে—তা এখন একটা ইস্যু হয়ে উঠেছে। ওরা এমনটা প্রায়ই করে থাকে। এবারই প্রথম নয়। সব সময়ই ওরা এমন করে। ”
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৬/আপডেট ১৯১০ ঘণ্টা
এইচএ/জেএম/