ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

‘আমরাও তো মিয়ানমারেরই নাগরিক’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
‘আমরাও তো মিয়ানমারেরই নাগরিক’

ঢাকা: মিয়ানমারের বৃহৎ শহর ইয়াংগুনের ডাউনটাউনে রয়েছে সুলে প্যাগোডা। যা দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। সুলে প্যাগোডার বিপরীত পাশেই রয়েছে একটি মসজিদ। আরেকটু কাছেই একটি চার্চ। ইয়াংগুন শহরের এমন চিত্র ধর্মীয় সৌহার্দ্যের কথাই যেন বলছে। 

তবে বাস্তব চিত্র ঠিক উল্টো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে। দেশটিতে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘুরা।

রোহিঙ্গা মুসলিমদের সঙ্গে মিয়ানমার কী করেছে, তা পুরো বিশ্বই জানে। সেখান থেকে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের কক্সবাজারে।  

‘জাতিগত নিধনে’র শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশে এসেছে, তা এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়। তবে শুধু রাখাইনের রোহিঙ্গারাই নয়, মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাস করা মুসলিমরাও বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।  

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র এক সাক্ষাৎকারে নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাই জানাচ্ছিলেন দেশটিতে বসবাসরত বৈষম্যের শিকার মুসলিম নাগরিকেরা।

অং নাইং সোয়ে, পেশায় ফটোসাংবাদিক এই মুসলিম ধর্মাবলম্বী মিয়ানমারের নাগরিক। ২০১৬ সাল থেকেই তার ওপর সন্ত্রাসীর ‘তকমা’ লাগানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অহেতুক কারণে তাকে টানা ১১ দিন জেলও খাটতে হয়েছে। কিন্তু তার অপরাধ কী? তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি দেশটির কর্তৃপক্ষ।  

তবে তার দাবি, মুসলিম হওয়াই তার একমাত্র ও বড় অপরাধ। বিবিসি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সোয়ে বলেন, ২০১৬ সাল থেকেই আমাকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিযুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ফেসবুকেও আমার নামে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়েছে। কেউ একজন নাকি আমাকে কোনো এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখেছে, এরপর আমাকে অভিযুক্ত করে ফেসবুকে আমার ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী কিছু না জেনেই আমাকে এখন ঘৃণা করে।

‘এছাড়া বিনা অপরাধে আমাকে জেলও খাটতে হয়েছে। পুলিশ অযথাই আমাকে দোষারোপ করেছে। এর পেছনের মূল কারণ হলো- তারা মুসলিমদের পছন্দ করে না। ’

সোয়ের বিরুদ্ধে হওয়া সেই মামলার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে বিবিসি। তবে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানবাধিকারকর্মী খিন সান্দার, মিয়ানমারের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করেন তিনি। তার ভাষ্য, দেশটিতে মুসলিমরা যদি চাকরির জন্য আবেদন করে, তাহলে অনেক সময় তারা চাকরি থেকে বঞ্চিত হন। চাকরিদাতাদের অপছন্দের কারণ শুধুমাত্র একটাই, তারা মুসলিম।  

‘এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতেই দেশটিতে মুসলিমরা বৈষম্যের শিকার হন। শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে আইডি কার্ড ও সিটিজেনশিপ কার্ড ইস্যু করাতে গিয়েও নানা ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। ’

নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে খিন সান্দার বলেন, আমার আইডি কার্ড ইস্যু করাতে প্রায় দুইবছর সময় নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অথচ যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে সময় লাগে মাত্র দুই সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ ২৮ দিন।

‘‘আমি যখন আমার কার্ড ইস্যুর জন্য ফর্ম পূরণ করছিলাম, তখন সেখানকার এক কমকর্তা আমাকে বলেন, ও তুমি একজন ‘কালার’ (মিয়ানমারের স্থানীয় একটি শব্দ, যেটি মুসলিমদের হেয় করতে ব্যবহার করা হয়)। আমরা তোমার জন্য কিছু করতে পারবো না। আমি সেদিন তার ব্যবহারে খুব হতাশ হয়েছিলাম। আমরা এমনটি আশা করি না,’’ বেশ হতাশ হয়ে বলছিলেন এই মানবাধিকারকর্মী।  

খিন সান্দারের পর্যবেক্ষণ, রোহিঙ্গা সংকটের পর মিয়ানমারে সংখ্যালঘুদের ওপর বৈষম্যের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।  

গোপন ফেসবুক গ্রুপ:

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিয়ে ফেসবুকে নানা বিভ্রান্তিমূলক ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়। সেগুলো বন্ধে তিন হাজার সদস্য নিয়ে ফেসবুকে একটি গোপন গ্রুপ খুলেছেন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। যে গ্রুপের কাজ- মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিয়ে এ দেশেরই কেউ ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য দিলে সেটি রিপোর্ট করা।

এ গোপন গ্রুপেরই এক সদস্য থিন অং মিন্ট। তার ভাষ্য, দেশজুড়ে আমাদের নিয়ে মিথ্যা সংবাদ ও বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়। কিন্তু কেউ-ই এর বিরুদ্ধে কিছু বলছে না। এসব মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমেই সহিংসতা ছড়ায়। এগুলো যাতে ছড়ানো না যায় ও কোনো ধরনের সহিংসতা সৃষ্টি না হয়, তাই আমি ওই গ্রুপে যোগ দিয়েছি।

বেশ আবেগ তাড়িত হয়ে এই অ্যাক্টিভিস্ট বিবিসি’কে বলেন, ‘আমরাও তো এ দেশেরই নাগরিক! নিজেদের তো আমরা তাই ভাবি। অথচ তারা আমাদের এদেশের নাগরিকই মনে করে না। এজন্য অবশ্যই আমাদের দুঃখ হয়, কষ্ট হয়। ’

রোহিঙ্গা মুসলিমসহ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয়দের এমন অত্যাচার ও বৈষম্যমূলক আচরণে দুশ্চিন্তা বাড়ছে দেশটিতে বসবাস করা সংখ্যালঘুদের। তাদের ধারণা, ভবিষ্যতে এ ধরনের অত্যাচার ও বৈষম্যের মাত্রা আরও বাড়তে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
এসএ/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।