জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথেই সুদৃঢ় হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রী। নয়াদিল্লি ও ঢাকা চাইছে বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করতে।
ভারত সাধারণত অন্য কোনও দেশের মহাপুরুষদের নামে ডাক টিকিট বের করে না। এর আগে শুধুমাত্র আব্রাহাম লিঙ্কন ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারের মৃত্যু শতবর্ষে এবং ভ্লাদিমির লেনিন ও হো চি মিনের জন্ম শতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল ডাক টিকিট। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভার্চ্যুয়াল শীর্ষ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ডাক টিকিট প্রকাশ করে ভারত বুঝিয়ে দিল বাংলাদেশ তাদের কতো বড় বন্ধু। শুধু তাই নয়, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে এই প্রথম কোন প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র বাহিনীর অংশ গ্রহণ। বাংলাদেশের আগে ভারতের কোনও প্রতিবেশীই এই সুযোগ পায়নি। আসলে ভারত যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মাথায় রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করতে চায়, এইসব তারই উদাহরণ।
বঙ্গবন্ধুর চেতনার আলোকেই প্রতিষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। তাই আগে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা জরুরি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমান অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দেশভাগ নিজের চোখের সামনে দেখেছেন। সাবেক ইসলামিয়া কলেজ অব ক্যালকাটা বা বর্তমানের মৌলানা আজাদ কলেজের পড়ার সময়ই শেখ মুজিব ছাত্র আন্দোলনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। বাংলার রাজনীতিতে তিনি গুরুত্ব পেতে শুরু করেন। দেশ ভাগের পর তিনি ফিরে যান ঢাকায়। এ কে ফজলুল হক, স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, নুরুল আমিন ও সাহেবজাদা মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মতো নেতারা থাকলেও শেখ মুজিবই হয়ে ওঠেন বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা। মাত্র ২৫ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বাঙালির নতুন রাষ্ট্র গঠনে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সর্বজনবিদিত।
বঙ্গবন্ধু জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব মানতেন না। তিনি চাননি ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ। বাঙালির জাতিসত্ত্বার জন্য লড়াই করেছিলেন তিনি। শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, মুসলিম লিগের বাংলা প্রাদেশিক নেতাদের বেশিরভাগই ছিলেন দ্বিজাতি নীতির বিরোধী। কিন্তু জিন্নাহ সেইসবে কান দেননি। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয় সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে। ভাষাগত পরিচয়ের দাবিতে গর্জে ওঠেন বাঙালিরা। ধর্মের আফিম দিয়ে তাদের দাবিয়ে রাখা যায়নি। বাঙালি বুঝে যায় ভাষাগত পরিচিতি ধর্মীয় পরিচিতির থেকে অনেক বেশি জরুরি। নিজের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি আর দক্ষ ও সাহসি নেতৃত্বের গুণে বঙ্গবন্ধুই হয়ে ওঠেন বাঙালির মুক্তিসূর্য। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিরা মেনে নেন তার নেতৃত্বকেই। দুঃসময়ের বন্ধু ভারতকে শত্রু না ভেবে প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনও বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। তিনিই হয়ে ওঠেন অগণিত স্বাধীনতাকামনী বাঙালির ভরসাস্থল।
২০০৪ সালে বিবিসির জনমত সমীক্ষায় প্রমাণিত হয় বঙ্গবন্ধুই সর্বকালের সেরা বাঙালি। জনপ্রিয়তার নিরীখে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও পিছনে ফেলে দেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই আস্থাভাজন ছিলেন। তার নেতৃত্বে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। ভারত তাতে যোগ্য সহায়তা জুগিয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দুটি ধারা কাজ করেছে। বেশিরভাগ মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে এলেও পাকিস্তানপন্থী রাজাকার, আল-বদররাও ছিল সরাসরি বিরুদ্ধ শিবিরে। ভারতীয় সেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাকে তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধেও কুৎসা ও অপপ্রচার। ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা বাংলাদেশে গণহত্যায় পাক-সেনাদের মদদ দিয়েছিল। দেশের স্বাধনীতার পরও বঙ্গবন্ধু ও ভারতের বন্ধুত্বের বিরোধিতা করে তারা। সেই ধারা আজও অব্যাহত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লিগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে আগলে ধরে ভারতের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করতে চাইছে। বঙ্গবন্ধুও এটাই চাইতেন। তারই প্রমাণ ৬ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক ব্রিগেড জনসভা। তিনি সেখানেও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেন। বলেছিলেন, ভারতের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা চিরকাল থাকবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর পাক-পন্থীরা ফের মাথাচাড়া দেয়। ভারতের বিরুদ্ধে শুরু হয় অপপ্রচার। ৩০ লাখ বাঙালির হত্যাকারী পাকিস্তানের হয়েই বাংলাদেশের মাটিতেও অনেকে সাফাই গাইতে থাকে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রপরিণত করতে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। তবে আশার কথা মুজিব-কন্যা, দেশনেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব্য রাজাকারদের সেই ষরযন্ত্র ভেস্তে দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের দিকে। ভারতের সঙ্গে ফের স্থাপিত হয়েছে বন্ধুত্ব।
আসলে বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র মুক্তির ডাকই দেননি, বাঙালির মননে গেঁথে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। উদারমনা জাতির পিতা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতেও সচেষ্ট ছিলেন তিনি। কিন্তু ঘাতকের দল তাকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের মাটি থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেই ধংস করতে চেয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের খুন করে পাকিস্তানপন্থীরা চেয়েছিল দেশের স্বাধীনতাকেই বিপন্ন করতে। কিন্তু তার কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রম আর দৃঢ় নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হাতিয়ার করে লড়াই করেন শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে বাংলাদেশের অগণিত মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে শুরু করেন দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। অবশেষে অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের সরকার। সেনা বা মৌলবাদিদের পরাস্ত করে হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী বা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে প্রধানমন্ত্রী তখতে রয়েছেন দেশনেত্রী শেখ হাসিনা। এটাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সূচক। যুদ্ধাপরাধীরা বিচারপর্বের শেষে শাস্তি পাচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে পালন করছে স্বাধীনতার ৫০ বছর। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান মাথায় রেখে বাংলাদেশ যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুত্বের হাত, ভারতও তেমনি বাংলাদেশের অগ্রগতিকে স্যালুট জানাতে কার্পণ্য করছে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতরত্ন ইন্দিরা গান্ধী যে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের বীজ বপন করেছিলেন, আজ বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে মহিরুহ হিসাবে বিকশিত। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কার্যক্রমকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী।