রমজান মাস এবং ফরজ রোজা শেষ হলেও বছরজুড়ে বিভিন্ন রোজা রয়েছে। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য সেসব রোজার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
এক দিন পর পর রোজা
এক দিন পর পর রোজা রাখাকে সওমে দাউদ বলে। দাউদ (আ.) এভাবে রোজা রাখতেন।
নবী (সা.) এটিক সর্বোত্তম রোজা বলেছেন এবং বেশি রোজা রাখতে আগ্রহীদের এভাবে রোজা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) আমাকে বলেন, তুমি কি সব সময় রোজা রাখো আর রাতভর নামাজ আদায় করে থাকো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, এরূপ করলে তোমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। যে বছরজুড়ে রোজা রাখল সে যেন রোজাই রাখল না।
প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা রাখাই বছরজুড়ে রোজা রাখা। তিনি বলেন, আমি এর চেয়ে বেশি সামর্থ্য রাখি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাহলে তুমি দাউদ (আ.)-এর রোজা রাখো। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন আর এক দিন রোজা ছেড়ে দিতেন।
তিনি শত্রুর সম্মুখিন হলে পলায়ন করতেন না। (বুখারি, হাদিস : ১৮৭৮; মুসলিম, হাদিস : ২৭৯৩)
সপ্তাহের রোজা
সপ্তাহের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখা রাসুল (সা.) পছন্দ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার (বান্দার) আমল (আল্লাহর কাছে) উপস্থাপিত হয়। আমি পছন্দ করি যে রোজা অবস্থায় আমার আমল উপস্থাপন হোক। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৪৭)
আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সোমবারের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, সেদিন আমি জন্মেছি এবং সেদিন আমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
(মুসলিম, হাদিস : ২৮০৭)
মাসের রোজা
প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজাকে আইয়ামে বিজের রোজা বলে। নিয়মিতভাবে এই তিন দিনের রোজা সারা বছর রোজা রাখার সমতুল্য। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমার বন্ধু নবী (সা.) আমাকে তিনটি অসিয়ত করেছেন। ১. প্রতি মাসে তিন দিন করে রোজা রাখা, ২. চাশতের দুই রাকাত নামাজ পড়া এবং ৩. ঘুমানোর আগে বিতর নামাজ আদায় করা। (বুখারি, হাদিস: ১৮৮০)
আশুরার রোজা
মহররম মাসের ১০ তারিখ হলো আশুরা। রমজানের রোজা ফরজ হওয়া আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর সে রোজার বিধান নফলে পরিণত হয়েছে। মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরার রোজার ক্ষেত্রে তার আগে বা পরে এক দিন মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার কথা নবী (সা.) বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররম মাসের রোজা অর্থাৎ আশুরার রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজ। (মুসলিম, হাদিস : ২৮১২)
শাবান মাসের রোজা
নবী (সা.) শাবান মাসে খুব বেশি পরিমাণে রোজা রাখতেন। ইমাম বুখারি (রহ.) বুখারিতে ‘শাবান মাসের রোজা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় তৈরি করেছেন। তিনি সেখানে শাবান মাসে নবী (সা.)-এর রোজাসংক্রান্ত হাদিস পেশ করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) শাবান মাসের চেয়ে কোনো মাসে বেশি রোজা পালন করেননি। তিনি প্রায় পুরো শাবান মাসই রোজা পালন করতেন। (বুখারি, হাদিস : ১৮৬৯; মুসলিম, হাদিস : ২৭৭৯)
এ ছাড়া মধ্য শাবানের রোজার বিষয়ে হাদিসে এসেছে—আলী বিন আবি তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, যখন শাবানের পঞ্চদশ রাত তোমাদের সম্মুখে এসে যায় তখন তোমরা তাতে নামাজ পড়ো এবং পরবর্তী দিনটিতে রোজা রাখো। (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮)
শাওয়াল মাসের রোজা
রমজানের পর শাওয়াল মাস। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখার বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত আছে। সে রোজাগুলো লাগাতার বা ভেঙে ভেঙে রাখা যায়। এ রোজার ফজিলত অনেক। আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে রমজানের রোজা রাখে, অতঃপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখে, সে যেন বছরজুড়ে রোজা রাখে। (মুসলিম, হাদিস : ২৮১৫)
জিলহজ মাসের রোজা
জিলহজ মাসের প্রথম থেকে নবম দিন পর্যন্ত মোট ৯টি রোজার ব্যাপারে হাদিসে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর কাছে অন্য কোনো দিনের ইবাদত অতটা বেশি পছন্দনীয় নয়, যতটা বেশি পছন্দনীয় জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের ইবাদত। এর প্রত্যেক দিনের রোজা এক বছর রোজার সমতুল্য আর এর প্রত্যেক রাতের ইবাদত কদরের রাতের ইবাদতের সমতুল্য। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৮)
জিলহজ মাসের নবম দিন হলো আরাফার দিন। সেদিনের রোজার ফজিলত আরো বেশি। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি আশা করি আরাফার দিনের রোজা তার পূর্ব ও পরের এক বছরের পাপ মোচন করে দেবে। (মুসলিম, হাদিস : ২৮০৩)
উল্লেখ্য, ইবাদতের মাধ্যমে সাধারণত সগিরা গুনাহ ক্ষমা হয় আর কবিরা গুনাহ তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা হয়।
মানতের রোজা
রোজার মানত করে থাকলে যে উদ্দেশ্যে মানত করা হয়েছিল তা পুরা হলে মানতকারীর ওপর রোজা পালন করা অপরিহার্য। নির্দিষ্ট দিনে রোজা পালন করার মানত করলে নির্দিষ্ট দিনে আর অনির্দিষ্ট দিনে রোজা পালন করার মানত করলে যেকোনো দিনে রোজা পালন করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাদের উচিত মানতকে পুরা করা। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৯)
কাজা রোজা
যৌক্তিক ও সংগত কারণে রমজানের রোজা আদায় করতে না পারলে পরে তার কাজা আদায় করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। আর কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পুরো করবে। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
কাফফারার রোজা
স্বেচ্ছায় রমজানের রোজা ভেঙে ফেললে কাজাসহ কাফফারা হিসেবে লাগাতার ৬০টি রোজা রাখতে হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কিসে তোমাকে ধ্বংস করেছে? সে বলল, রমজানে রোজা অবস্থায় আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমার দাস মুক্তির সামর্থ্য আছে? সে বলল, না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি কি দুই মাস লাগাতার রোজা রাখতে পারবে? সে বলল, না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি কি ৬০ জন মিসকিনকে খাবার খাওয়াতে পারবে? সে বলল, না। (বুখারি, হাদিস : ১৮৩৪; মুসলিম, হাদিস : ২৬৫১)
এ হাদিস থেকে স্বেচ্ছায় রমজানের রোজা ভেঙে ফেললে কাফফারার বিধান প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কাজের কাফফারায় রোজা পালন করার বিধান রয়েছে।
লেখক: ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা, সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
এসআই