জিহ্বা আল্লাহতায়ালার বিচিত্র সৃষ্টির রহস্যের মধ্যে অন্যতম। বাস্তবিক অর্থে তাকে একটি মাংসখণ্ড মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তার শক্তি অনেক।
এই জিহ্বা অনেক পাপের উত্স। মিথ্যা বলা মহাপাপ, কিন্তু এই জিহ্বার মদতেই মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নেয়। মিথ্যা ও বক্র কথা বললে মানুষের মন অমসৃণ আয়নার মতো কর্কশ ও আঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে। অমসৃণ আয়নায় যেমন পরম সুন্দর মুখমণ্ডলও কুশ্রী ও ভীষণ কদাকার দেখায়, কোনো বস্তুর যথার্থ ছায়া প্রতিফলিত হয় না, কর্কশ ও টেরা হৃদয়ফলকেও তদ্রূপ কোনো বস্তুর ছায়া প্রতিফলিত হয় না। এজন্যই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অন্তর ঠিক না হওয়া পর্যন্ত ইমান ঠিক হয় না এবং জিহ্বা ঠিক না হওয়া পর্যন্তও ইমান ঠিক হয় না। ’
জিহ্বার যথার্থ ব্যবহারে একজন মানুষ হতে পারে ইমানের বলে বলীয়ান, আবার অনর্থক কথনে হতে পারে সমাজহারা, রাষ্ট্রহারা; এমনকি ধর্ম থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। যারা জিহ্বাকে অপপ্রয়োগ করে বাজে কথার তুবড়ি ফোটায়, অনর্থক ও মিথ্যা কথার মালা গাঁথে, ওই মানুষগুলোকে সবাই সর্বকালে সর্বমহলে নিন্দার পাত্র হিসেবেই জানে।
কথাবার্তাতেই মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মনোভাব প্রকাশ পায়। মানুষ যতক্ষণ চুপ থাকে ততক্ষণ নিজের ব্যক্তিত্ব ও সব ভুল ঢাকা থাকে। আর নিজের যশ-খ্যাতি নিজ মুখে প্রকাশ করা থেকে অন্যের মুখ দিয়ে এলে আরও সম্মান ও বড়ত্বের কারণ হয়। আর এই বাড়তি সম্মানটা অবশ্যই জিহ্বাকে সংযুক্ত রাখার মাঝে নিহিত থাকে।
জিহ্বা থেকে বহু আপদের জন্ম হয়। আর সে আপদ থেকে নিস্তার লাভ বড়ই কঠিন। তবে নীরবতা অবলম্বনই নিষ্কৃতি বা মুক্তিলাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূলের বাণী, ‘যে ব্যক্তি চুপ রয়েছে সে মুক্তি পেয়েছে। ’ একমাত্র চুপ থাকার মাঝেই রয়েছে অন্যায় থেকে মুক্তি প্রপ্তি ও সফলতা।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যত্র বলেন, ‘উদর, কামেন্দ্রিয় ও জিহ্বার ক্ষতি থেকে আল্লাহ যাকে বাঁচিয়েছেন সেসব বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে। ’
হজরত মায়াজ (রা.) একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন কাজ উত্তম?’ তিনি স্বীয় পবিত্র জিহ্বা মোবারক মুখ থেকে বের করে আঙুল দিয়ে চেপে ধরলেন, অর্থাৎ ইঙ্গিতে বললেন, মৌন থাকাই উত্তম কাজ।
হজরত ওমর (রা.) বলেন, আমি একবার হজরত আবু বকর (রা.)-কে দেখলাম, তিনি হাত দিয়ে স্বীয় জিহ্বা টানছেন এবং রগড়াচ্ছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূলের প্রতিনিধি, আপনি কি করছেন? তিনি বললেন, এই ক্ষীণ বস্তুটি আমার ওপর অনেক কাজ চাপিয়ে দিয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, জিহ্বাই মানুষের অধিকাংশ পাপের উত্স। একবার তিনি লোকদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘সহজতম ইবাদত তোমাদের শিক্ষা দিচ্ছি, তা হলো নীরব জিহ্বা ও সৎ স্বভাব, তবে ভালো ও উপকারমূলক কথা বলা নিন্দনীয় নয়, বরং নিরর্থক বলার চেয়ে ভালো কথা বলাই উত্তম। আল্লাহর নবী বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও কিয়ামতের দিনের ওপর ইমান এনেছে তাদের বলে দাও, তারা যেন ভালো কথা ছাড়া আর কিছুই না বলে অথবা নীরব থাকে।
লোকে হজরত ইসা (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করল, আমাদের এমন কিছুর সন্ধান প্রদান করুন, যা দিয়ে আমরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারব। ’ তিনি বললেন, কখনও কথা বোলো না। তারা বলল, এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বললেন, ‘তাহলে ভালো কথা ছাড়া আর কিছুই বোলো না। ’ রাসূল (সা.) বলেন, কোনো মুসলমানকে গম্ভীর ও নীরব দেখতে পেলে তার সংসর্গে যাও। এ ধরনের ব্যক্তি অন্তর্দৃষ্টি ও জ্ঞানহীন হতে পারে না।
কথা বেশি বলার কারণে নিরপরাধ ব্যক্তি প্রায়ই দোষের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অনেক সময় এর প্রায়শ্চিত্ত সারা জীবন বহন করতে হয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘কারাবদ্ধ থাকার জন্য জিহ্বার মতো এমন উপযুক্ত পদার্থ আর কিছুই নেই। ’
হীরা, মুক্তা, পান্নার চেয়ে মহা মূল্যবান বাণীগুলো রাসূল (সা.) তার উম্মতের কল্যাণের নিমিত্তে রেখে গেছেন। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত, নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিষয়গুলোকে উপলব্ধি করে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা, যা দিয়ে খুলে যাবে আমাদের সফলতার দ্বার। রুদ্ধ হবে সব অমঙ্গল আর পাপের পথ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘন্টা, মে ১০, ২০১৬
এমএ/