ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

কওমি সনদের স্বীকৃতি: সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, সিনিয়র বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৭
কওমি সনদের স্বীকৃতি: সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আল্লামা শফীর কুশল বিনিময়

১১ এপ্রিল রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদরাসার আলেমদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। ওই বৈঠকে আলেমদের বেশ কিছু দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হয়েছে। কওমি মাদরাসার আলেমরা কোনো রাজনৈতিক দলের লোক হিসেবে ওই বৈঠকে যাননি। তারা বৈঠকে অংশ নিয়েছেন, আলেমদের প্রতিনিধি ও অভিভাবক হিসেবে।

শিক্ষা ও সামাজিক শক্তি হিসেবে এ দেশের জনজীবনে অালেম-উলামাদের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনসহ এ দেশে ইসলাম চর্চার ক্ষেত্রে কওমি আলেমরা ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর তাদের কথা শোনা বা দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।

অপর দিকে, কওমি আলেমরাও সরকারপ্রধানের সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে আলোচনায় বসাটাই স্বাভাবিক। এটা দোষের কিছু নয়। বৈঠকে কওমি মাদরাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় ও দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিসমূহকে ভিত্তি ধরে প্রধানমন্ত্রী কওমি আলেমদের দীর্ঘদিনের দাবি কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, দাওরায়ে হাদিসের ডিগ্রি ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির সমান মর্যাদা পাবে।  

সরকারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা গ্রহণকারী দেশের কওমি শিক্ষা বোর্ডগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। সারা দেশের কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা একই প্রশ্নপত্রে নেওয়া হবে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মতো পরীক্ষার উত্তরপত্রও একসঙ্গে মূল্যায়ন ও ফল প্রকাশ করা হবে। কওমি মাদরাসা দাওরায়ে হাদিসের সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি এই কাজ পরিচালনা করবে।
১১ এপ্রিল গণভবনে শীর্ষস্থানীয় কওমি আলেমদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদান করেন
কমিটিতে সরকারের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। এ কমিটি সনদবিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বলে বিবেচিত হবে। কমিটির নিবন্ধিত মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্সের সমমান বলে বিবেচিত হবে। এ কমিটির অধীনে ও তত্ত্বাবধানে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা হবে। কমিটি সিলেবাস প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার সময় নির্ধারণ, অভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল ও সনদ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক বা একাধিক উপ-কমিটি গঠন করতে পারবে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়গুলো অবহিত করবে কমিটি। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, এ কমিটি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকবে।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে তা বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কওমির সনদের স্বীকৃতি নিয়ে নানা প্রক্রিয়া বিভিন্নভাবে চলতে থাকে। সর্বশেষ এর দৃশ্যমান একটি অগ্রগতি দেখা গেল। এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক।

আমরা মনে করি, শুধু সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা দিলেই কেবল সমস্যার সমাধান হবে না। তা বাস্তবায়ন, তথা কওমি সনদকে যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে কওমি মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সমমানের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী কওমি মাদরাসায় পড়ছে, তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।  
১১ এপ্রিল গণভবনে শীর্ষস্থানীয় কওমি আলেমদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদান করেন
এ দেশের গরিব, অভাবী ও এতিম সন্তানদের বড় একটি অংশ কওমি মাদরাসায় পড়ে থাকে। মাদরাসাগুলো তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে। এর মাধ্যমে কওমি মাদরাসাগুলো আর্থিক সীমাবদ্ধতার মাঝেও বড় ধরনের সামাজিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। সনদের স্বীকৃতির ফলে আলেমদের মহানুভবতার এই দিকটি সমাজে অালোচিত হবে, তাদের দেখে আরও অনেকেই এভাবে শিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় এগিয়ে আসবে।

কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি ঘোষণার পর বেশ কয়েকটি মহল এর প্রবল বিরোধিতা করে যাচ্ছে। বিরুদ্ধবাদীদের দলে যেমন রয়েছেন দেশের গোঁড়া ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের একটি অংশ। তেমনি রয়েছেন হেফাজতে ইসলামের কাঁধে বন্ধুক রেখে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখা গোষ্ঠীটিও। অন্যদিকে কওমি সনদকে সরকারি স্বীকৃতির প্রতিবাদে শনিবার (১৫ এপ্রিল) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত সমন্বয় কমিটির ব্যানারে সাংবাদিক সম্মেলন করে রীতিমতো কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।  

আমরা মনে করি, কওমি আলেমদের হেয়প্রতিপন্ন করে কিংবা সনদের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রচার প্রোপাগান্ডা চালানো দায়িত্বহীন আচরণ। হ্যাঁ, সরকারের নীতির সমালোচনা হতে পারে; কিন্তু কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করা কোনো যুক্তির কথা নয়।

প্রজ্ঞাপন দেখতে এখানে ক্লিক করুন-

এর মাধ্যমে মূলত প্রগতিশীলতার নামধারী কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীর চরমপন্থি মনোভাব ফুটে উঠেছে। তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ মাদরাসা ছাত্রদের সমাজের মূলস্রোতে মেশানোর শুভ ও অনন্য উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছেন। অথচ এ দেশে শিক্ষার বিস্তার কিংবা হতদরিদ্র শ্রেণীর মানুষ, এতিম-অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর উদাহরণ তারা সৃষ্টি করতে পারেননি। সমাজের মধ্যে বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করা তাদের লক্ষ্য বলে অনেকে মনে করেন।

বস্তুত কওমি মাদরাসার আলেমদের মধ্যকার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সরকারের সঙ্গে আস্থার দূরত্বের কারণে কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়টি আটকে ছিল। এখন যেহেতু জট খুলেছে- তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, কওমি শিক্ষাকে তার স্বকীয়তা বজায় রেখে সমাজের মূল স্রোতধারার সঙ্গে একীভূত করার ব্যবস্থা নিতে নেতৃবৃন্দ যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। সেই সঙ্গে মাদরাসা কিংবা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে এমন কর্মকাণ্ড, মনোভাব এড়িয়ে চলবেন।  

আমরা কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগের প্রশংসা করি। একই সঙ্গে কওমি মাদরাসার সনদ কর্মজীবনে যাতে বাস্তবে কার্যকর হয়, সে ব্যাপারে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশা করি।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৭
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।