কান (ফ্রান্স) থেকে : দক্ষিণ ফরাসি উপকূলের শহর কানে ১৪ দিন ধরে আছি। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানে কান চলচ্চিত্র উৎসবের পোস্টার শোভা পাচ্ছে।
শহরটিতে আসা পর্যটকদের জন্য রয়েছে ট্রামের মতো বিশেষ ট্যুরিস্ট বাস। এগুলোতে আছে গান শোনার হেডফোন। এখানকার বাসিন্দাদের যাতায়াতের অন্যতম পরিবহন হলো বাস। সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণের জন্য আছে ছাদখোলা পামবাস। এসব বাসের যাত্রী ছাউনিতে ইতোপূর্বে উৎসবে আসা তারকাদের বড়সড় ছবি যত্ন করে রাখা। এগুলো কতো সালে তোলা উল্লেখ আছে তা-ও।
গার দি কান ট্রেন স্টেশনের ঠিক পাশে একটি বাস স্টেশন। এখানে জর্জ ক্লুনি থেকে শুরু করে হলিউড ও ফরাসি তারকাদের ছবি দেখলাম। উৎসবের মূলকেন্দ্র প্যালে ডি ফেস্টিভ্যাল ভবনের দিকে যেতে কান রিভিয়েরা হোটেলের দেয়ালজুড়ে প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর বিশাল ছবিটা সম্মোহন জাগায়।
রোববার (২২ মে) সমাপনী দিনে খুব একটা ভিড় ভাট্টা নেই। ফাঁকতালে গেলাম ভিলেজ ইন্টারন্যাশনাল অংশের সমুদ্রের দিকে। এই পাশটাকে বলে রিভিয়েরা (ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল)। কান উৎসবকে লক্ষ্য রেখে এখানে নোঙর ফেলেছে বিখ্যাত টিভি ও চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা প্রতিষ্ঠানের প্রমোদতরী।
এসব ইয়ট দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম একেবারে সাগরপাড়ে। এখানকার হাওয়ারা বড়ই পাগলা! পারলে আস্ত মানুষকেই উড়িয়ে নিয়ে যায়! সমুদ্রের খুব কাছাকাছি বলেই হাওয়ার বেগ এতো। জায়গাটা বেশ নয়নাভিরাম। সামনে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। অদূরে লাইটার হাউস। রাতে সাগরে ভাসমান জাহাজগুলোকে তীর বোঝানোর সংকেতের কাজ করে এটি।
একই পথে ফিরে খেতে গিয়ে নিয়মিত একটি দিক নজরে পড়লো। লর্ড ব্রোগহাম স্কয়ারের সামনে দিনের বেলায় বেশকিছু কবুতরের আনাগোনা থাকে। আর থাকেন সেলফি স্টিক ও হ্যাট ফেরিওয়ালারা। তবে পুলিশ এলেই সরে পড়েন তারা। সাগরপাড়ের দিকেও এই ফেরিওয়ালাদের বেশ কয়েকজনকে দেখলাম। ফরাসি ভাষায় তারা কেনার জন্য ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিভিন্ন দেশের প্যাভিলিয়নগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা এখানে দাঁড়াতে পেরেছেন।
এদিনও এখানে সূর্যস্নান করছিলেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষকে। বালুকাবেলার ওপর কেউ শুয়ে, কেউ বসে রোদ পোহাচ্ছেন। সমুদ্র সৈকত ধরে যেতে যেতে দেখলাম প্রাডা, গুচি, আরমানি, রবার্তো ক্যাভালি, ডলচে অ্যান্ড গ্যাবানা, মাইকেল করসের মতো বিখ্যাত ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানের শোরুমগুলো। আরেকটু এগোতেই টিম বার্টনের নতুন ছবি 'অ্যালিস থ্রো দ্য লুকিং গ্লাস' ছবির বিশাল এক পোস্টার সটান করে রাখা। এতে ম্যাড হেটারের সাজে জনি ডেপকে দেখে হাসি পেলো।
পা বাড়াতেই একে একে দেখলাম হোটেল মার্টিনেজ, কার্লটন, জেডব্লিউ ম্যারিয়ট, হোটেল ম্যাজেস্টিক ব্যারিয়ের ও লে গ্র্যান্ড হোটেল। কানে এলে বিখ্যাত তারকারা এসব হোটেলেই থাকেন। এর মধ্যে হোটেল মার্টিনেজে সাধারণত দামি তারকারা ওঠেন। তাই এর সামনে উৎসুক মানুষের জটলা দেখা গেলো। রূপালি দুনিয়ার নক্ষত্রদের একনজর দেখতেই তাদের মধ্যে এই উন্মাদনা। কার্লটন হোটেলের প্রাঙ্গণে আছে সোনালি রঙা একটি নারীমূর্তি। ডানা মেলে হাত উঁচু করে তিনি ধরে আছেন পামগাছের পাতা।
ফিরতি পথে দেখলাম বেশ কয়েকজন বয়স্ক মানুষ নিজেদের অাঁকা চিত্রকর্ম বিক্রির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। আগোরা নামে একটি তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মের দিকে তাকিয়ে মনে হলো মরু অঞ্চল! তাঁবুটির দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কয়েকজন। এখানেই আয়োজকদের আমন্ত্রণে আসা তারকারা খাওয়া-দাওয়া করেন। আগোরার সামনে উৎসবের অফিসিয়াল গাড়িগুলো। সবই ঝকঝকে। দেখলে মনে হবে এই মাত্র কেনা বুঝি!
আচমকা গান-বাজনার শব্দ শুনে সম্বিৎ ফিরলো। প্রয়াত রবিন উইলিয়ামস 'মিসেস ডাউটফায়ার' ছবিতে যেভাবে নারী সেজেছিলেন, অবিকল সেই সাজে একজন মিউজিক্যাল মোটরবাইক চালিয়ে এখানে এসেছেন একজন। তার সঙ্গে ছবি তুলতে মেতে উঠলো কয়েকজন পর্যটক।
এদিকে সমাপনী আয়োজনের জন্য লালগালিচা সাজানোর কাজ চলছে। চুল পরিমাণ ময়লাও ঝেটে ফেলা হচ্ছে। চোখ ঘুরিয়ে ফিরতেই বিখ্যাত কয়েকজন তারকাদের হাতের ছাপ দেখলাম। শ্যারন স্টোন থেকে শুরু করে আকিরা কুরোসাওয়া,মার্টিন স্করসিস, জেমস বন্ড তারকা টিমোথি ডালটন, মাইকেল ডগলাস, হুপি গোল্ডবার্গ, ভ্যান ডেম, ভ্যানেসা রেডগ্র্যাভসহ অনেকের বেশ পুরনো হাতের ছাপ।
প্যালে ডি ফেস্টিভ্যাল ভবনের মূল ফটকের সামনেও রয়েছে বিখ্যাত অনেক তারকার হাতের ছাপ! সোফিয়া লরেন, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, সিলভেস্টার স্ট্যালোন, ইজাবেলা রোসেল্লিনি, ভ্যানেসা রেডগ্র্যাভ, ক্যাথেরিন দেন্যুভ-সহ আরও অনেক তারকার হাতের ছাপ দেখলাম। কানে তাদের অংশ নেওয়ার নিদর্শন হিসেবে রাখা হয়েছে এগুলো।
ভবনটির সামনে গত ১১ দিন মোটামুটি সারাক্ষণই মানুষ ঢুকেছে, বের হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম নয়দিন তো গাদাগাদি অবস্থা ছিলো! রোববার বেশ ফাঁকা। তাই ধীরে-সুস্থে ঢুকতে পেরেছি। প্রথমেই সমাপনী অনুষ্ঠানের ইনভাইটেশন সংগ্রহ করলাম। ভদ্রমহিলা এটি দিয়ে বললেন, 'সি ইউ নেক্সট ইয়ার। ' প্যালে ডি ফেস্টিভ্যাল ভবনের তিনতলায় সাংবাদিকদের সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন তথ্য বিভাগে গিয়ে কথাবার্তা শেষে সবাই একই সুরে বললেন, 'দেখা হবে আগামী বছর। '
বাংলা সময়: ১৮০২ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৬
জেএইচ/পিসি