এক গ্রামে বাস করতো দুই পালোয়ান। কে বড় পালোয়ান তা যাচাই করার জন্য একদিন আয়োজন করা হলো মল্লযুদ্ধের।
পরাজিত পালোয়ান বললো, তুমি আমার পিঠ থেকে এক কেজি মাংস কেটে নাও। কিন্তু বিজয়ী পালোয়ান বললো, তা হবে না। বাজিতে তো এমন কথা ছিল না। আমার যেখান থেকে ইচ্ছা মাংস কেটে নিবো। আমি তোমার বুক থেকেই মাংস নিতে চাই। শুরু হলো দু’জনের মধ্যে তর্কযুদ্ধ। তখন তারা বাধ্য হয়ে গেলো বীরবলের কাছে। বীরবল সব শুনে বিজয়ী পালোয়ানকে বললো, বাজি অনুযায়ী তোমার দাবি ন্যয়সঙ্গত। তুমি পরাজিত পালোয়ানের বুক থেকেই এক কেজি মাংস কেটে নেবে। তবে একটা কথা। এক কেজির এক তিল কম বা বেশি মাংস যেন না নেওয়া হয়। যদি এই নির্দেশ লঙ্ঘন করো তবে তোমাকে কিন্তু কঠিন শাস্তি পেতে হবে। আর একটা কথা। বাজি অনুযায়ী তুমি কেবল মাংসই পাবে। দেখো, একফোঁটাও রক্ত যেন না পড়ে। এবার আমাদের সামনেই তুমি মাংস কেটে নাও।
বিচারের রায় শুনে বিজয়ী পালোয়ানের হাত থেকে পড়ে গেলো ছুরি। সে আর মাংস কাটতে এগিয়ে এলো না। পালিয়ে বাঁচলো। এমনই বুদ্ধিমান আর যুক্তিবাদী ছিলেন বীরবল। উপস্থিত বুদ্ধি, তীক্ষè রসবোধসম্পন্ন এবং হাস্যরসিক সেই বীরবল এবং তার প্রাসাদসম বাড়ির কথাই শোনাব আজ।
দিল্লির বদলে আগ্রায় তখন সম্রাট আকবরের রাজধানী। একদিন আগ্রার পাশের জঙ্গলে শিকার করতে বেরিয়ে দলছুট হয়ে যান আকবর। হারিয়ে ফেলেন ফিরে যাওয়ার পথ। এমন সময় পথের মাঝে দেখা হলো এক কিশোরের সঙ্গে। নাম তার মহেশ দাস। সম্রাট তাকে জিজ্ঞেস করেন, কোন পথটি আগ্রার দিকে গেছে? প্রশ্নের জবাবে মহেশ বললো, পথতো কোথাও যায় না। মানুষই পথ মাড়িয়ে যায়। এরপর ঐ কিশোরটি সঠিক পথের হদিস দিয়ে দেয়। বুদ্ধিমত্তা আর রসবোধের পরিচয় পেয়ে সম্রাট নিজের আঙুল থেকে একটি বাদশাহী আংটি খুলে উপহার দেন মহেশকে।
এরপর কেটে যায় কয়েক বছর। মহেশ তখন যুবক। আগ্রার কাছে যমুনার তীরে তিকোয়ানপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান মহেশ ঘর ছাড়লো অর্থ উপার্জনের আশায়। সঙ্গে পুঁটলিতে বাঁধা কিছু শুকনো খাবার আর ছেড়া শতরঞ্জি। অবশ্য সম্রাটের দেওয়া আংটিটাও সঙ্গে ছিল তার। অনেক পথ কষ্ট স্বীকার করে মহেশ হাজির হলো আগ্রা থেকে আরও ৩৬ কিলোমিটার দূরে সম্রাটের নতুন রাজধানী শহর ফতেপুর সিক্রিতে।
প্রহরীকে বাদশার দেওয়া আংটিটি দেখিয়ে মহেশ পৌঁছাল দরবার কক্ষে। বাদশা আকবর ঠিক সেসময় সভাসদদের কাছে জানতে চাইলেন, পৃথিবীতে সুন্দর ফুল কী? সভাসদদের কারও উত্তর পছন্দ হলো না সম্রাটের।
সবার বলা শেষ হয়ে গেলে মহেশ সাহস করে বলে উঠলো, কাপাস ফুল জাহাপনা। উত্তর শুনে সভাসদরাতো হেসে কুটি কুটি। সম্রাট সবাইকে থামতে বলে জানতে চাইলেন, কাপাস ফুল কেন সুন্দর? মহেশ বললো, এই ফুলের গুটি থেকে যে তন্তু পাওয়া যায় তা থেকে সূক্ষè মসৃণ কাপড় তৈরি হয়। মসলিন আর মেয়েদের অতি প্রিয় ওড়না এই তন্তু থেকেই তৈরি হয়। সাদা ময়ূয়ের ছড়ানো পেখমের মতো ঐ কাপাস ফুলই মানুষকে আনন্দ দেয় অনেক বেশি। উত্তর শুনে বিস্মিত আকবর যুবকের পরিচয় জানাতে চাইলেন। যুবক তখন সম্রাটের দেওয়া আংটিটি দেখিয়ে এখানে আসার কারণটি জানলো। আকবর খুশি হয়ে বললেন, ঠিক আছে তুমি আমার কাছেই থাকবে। তুমি হবে আমার অন্যতম সভাসদ। আর আজ থেকে তোমার নতুন নাম দিলাম-বীরবল। এই নামের অর্থ কি জানো? যুবক বললো, জানি জাহাপনা। সেই থেকে মহেশ হয়ে গেলো বীরবল।
দূরদৃষ্টি, বুদ্ধি, মেধা, জ্ঞান সর্বোপরি অসামান্য রসবোধের কারণে বীরবল শিগগির হয়ে উঠলেন সম্রাট আকবরের একান্ত বিশ্বাসভাজন বন্ধু ও পরামর্শদাতা। আপনগুণে বীরবল হয়ে উঠলেন সম্রাটের প্রধান মন্ত্রণাদাতা-উজির বীরবল।
মুঘল সাম্রাজ্যের পুরো প্রশাসন এবং রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়টি দেখাশোনার ভার পড়লো তার ওপর। সম্রাটের সঙ্গে তার বন্ধুসুলভ সুসম্পর্কের কারণে সব নিয়ম ভেঙে আকবর তার প্রাসাদ চত্বরের মধ্যে একমাত্র বীরবলের জন্য ছোট্ট এক সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করে দেন। যে প্রাসাদ আজে অটুট আছে আগ্রার ফতেপুর সিক্রিতে।
আগ্রা থেকে সম্রাট আকবরের নতুন রাজধানী ফতেপুর সিক্রির দূরত্ব ছিল ৩৬ কিলোমিটার। সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা পরিত্যক্ত নগরীটি যেন স্থাপত্য ও শিল্পকর্মের অনন্য সংগ্রহশালা। এখানের দুর্গ ও প্রাসাদগুলো লাল রঙের বেলেপাথরে তৈরি। প্রধান তোরণদ্বার ৫৪ মিটার উঁচু। পাথুরে উঠানের চারপাশে আছে পরিখা। ভিতরে জলাধার, অট্টালিকা, উদ্যান, গোসলখানা, মসজিদ, স্মৃতিসৌধ আরো কতো কী! এখানে আছে দেওয়ান-ই-আম, সম্রাটের সিংহাসন এবং সবচেয়ে কারুকার্য খচিত তুরস্ক সুলতানের বাসগৃহ। বৌদ্ধ অনুকরণে নির্মিত পাঁচতলা ভবন। ফতেপুর সিক্রির সবচেয়ে বড় প্রাসাদের নাম যোধাবাঈ প্রাসাদ এবং বীরবল প্রাসাদ। এসব প্রাসাদের জলাশয়ের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ১৮ মিটার উঁচু ‘হিরণ মিনার’। এই মিনারে বসেই সম্রাট শিকার করতেন।
সম্রাট কোনো যুদ্ধে গেলে বীরবলকে সব সময় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। প্রাসাদ চত্বর থেকে দুজন বেরুতেন একসঙ্গে। একবার উত্তর-পশ্চিম ভারতে বিদ্রোহ দমনে সম্রাটের সঙ্গী হয়ে সেখানে যান বীরবল। সৈন্যদল নিয়ে পেশোয়ারের কাছে পৌঁছে তিনি নিজেও নেমে পড়েন যুদ্ধ ক্ষেত্রে। ঐ যুদ্ধে আকবর জয়ী হলেও শেষ রক্ষা হয় না বরীবলের। ১৫৮৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন যুক্তিবাদী এবং রসিক এই মানুষটি। তবে তাঁর মৃত্যুসাল পাওয়া গেলেও ভারতের মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডে জন্মানো এই কবির জন্মসাল ও তারিখ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা হয় তার জন্ম ১৫২৮ সালে।
তোমরা জানলে হয়তো অবাক হবে যে, বীরবল একজন বড়ো সভাকবিও ছিলেন। আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) প্রতিভাবান নয় জন কবি, শিল্পী ও চিত্রকরদের অন্তর্ভুক্ত করে ‘নবরত্ন’ নামে যে বিশেষ সভা গড়ে তুলেছিলেন বীরবল ছিলেন তার অন্যতম রতœ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি[email protected]