ওষুধ আমাদের পরিচিত পরিচিত অপ্রিয় একটি জিনিস। কারণ রোগে না পড়লে ওষুধের কথা মনে আসে না কারো।
তবে, ওষুধ যে রোগ ভালো করে, এমনকি কখনো কখনো জীবনও বাঁচায়, সেটিও আমরা জানি। কিন্তু ওষুধ কীভাবে কাজ করে সেটি কি সবাই জানি? বা সেটা জানার দরকারই বা কি? বা আসলে ওষুধ কি? কবে থেকে মানুষ ওষুধ খায়? কিংবা ওষুধ খাওয়া কি সবসময় ভালো? ওষুধ নিয়ে পড়াশুনা কারা করে? তা কি আদৌ মজার? এসব নিয়েই এই লেখা।
প্রথমে জানা যাক, ওষুধ কি? যা রোগ ভালো করে তাই ওষুধ; এটি আমরা জানি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে আবার ওষুধ হলো- যা রোগ নির্ণয়ে, প্রতিকারে ও প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। যেমন, যদি বেরিয়াম সালফেট খাইয়ে রোগীর পেটের সমস্যা আছে কিনা দেখা হয়, তাহলে সেটি ওষুধ। আবার আমাদের পরিচিত প্যারাসিটামলও ওষুধ; ওষুধ বিভিন্ন রোগের টীকাও।
১৯৪০ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণের যে আইন প্রণীত হয় তা অনুসারে, ব্যান্ডেজ, প্লাস্টার এসবও ওষুধ; এমনকি উকুন-মারা শ্যাম্পুও ওষুধ! ওদিকে, কবিরাজী গাছ-গাছড়া, হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধও সে আইনের আওতায় পড়ে।
তবে ওষুধের সংজ্ঞা অবশ্য চিরকাল এমন ছিলো না। প্রথম কবে মানুষ ওষুধ খাওয়া শুরু করলো তা জানা না গেলেও, সভ্যতার চেয়েও ওষুধ ব্যবহারের ইতিহাস পুরোনো এমন নিদর্শন পাওয়া যায়।
মজার ব্যাপার হলো, আমাদের নিকটতম জ্ঞাতি শিম্পাঞ্জীও কিছু ভেষজ গাছ চেনে এবং প্রয়োজন মতো কিছু রোগে ব্যবহার করতে পারে, এমনটি দেখা গেছে। ফসল ফলাতে শেখার আগে, ওষুধ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানও এর থেকে খুব একটা বেশি ছিলো না। বরং, রোগ সারানোর জন্য ছিলো কিছু সংস্কার, যা এযুগে উদ্ভট মনে হবে।
যেমন ধরা যাক: রক্ষাকবচ হিসেবে মৃত মানুষের খুলির অংশবিশেষ পরিধান, কিছু নির্দিষ্ট পশু শিকার করা থেকে বিরত থাকা, এমনকি সমস্ত শরীরে পশুর বিষ্ঠা লাগানো!
কৃষিকাজ শেখার পর, উদ্ভিদের সাথে মানুষের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হতে শুরু করে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন গাছ, যারা রোগ নিরাময় করতে পারে। তবে লেখালেখির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রথম কে কবে ওষুধ ব্যবহার করলো এ ব্যাপারটি জানা প্রায় অসম্ভব।
তবে প্রাচীন মিসরে ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় যে ওষুধব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছিলো, তার প্রভাব ইউরোপে অনেকদিন পর্যন্ত থেকে গেছে। ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে গড়ে ওঠে আয়ুর্বেদের মতো বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার। ভারতবর্ষের শত শত ঔষধি গাছ সেখানে স্থান পায়। চীনের ৪০০ খ্রিস্টপূর্বের নথিতে ঔষধি গাছ ব্যবহারের কথা পাওয়া যায়।
৯৮০ খ্রিস্টাব্দে আরবদেশের ওষুধপত্র চলে যায় ইউনানি নামকরণে। বিশ্বজোড়া খ্যাতি পায়। এছাড়া সমস্ত বিশ্বেই বিভিন্ন সমাজে, আদিবাসী গোষ্ঠীতে লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতি গড়ে ওঠে। এরপর খানিকটা আধুনিক যুগে আসে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ও অ্যারোমাথেরাপি। আধুনিক ওষুধবিজ্ঞান এই সব ধরনের প্রাচীন ও লৌকিক জ্ঞান থেকে একটু একটু করে নিয়ে ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে।
অসুখ কিভাবে হয় এবং ওষুধ কিভাবে কাজ করে এ বিষয়ে মানুষ জানতে পেরেছে বেশি দিন হয়নি। রাসায়নিকভাবে ওষুধ প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে কেবল বিশ শতকে এসেই।
যে কোনো জীব বেঁচে থাকে কিছু জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে। ওষুধ কাজ করে জীবের রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি উল্টে দিয়ে। যেমন, ব্যাকটেরিয়া একটি অণুজীব। এরা যে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে পুঁজি করে বেঁচে থাকে, অ্যান্টিবায়োটিক ধরনের ওষুধ সেগুলোকে বাধা দেয়। ফলে ব্যাকটেরিয়া বাঁচতে পারে না আর আমরা দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠি। আবার, মাথা ধরলে যখন আমরা ওষুধ খাই তখন ওষুধ আমাদের দেহের রাসায়নিক বিক্রিয়াকেই উল্টেপাল্টে দেয়।
জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়াকে উল্টেপাল্টে দেয় বলে ওষুধ খাওয়া সবসময় ভালো নয়। বলা হয়, নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে শরীর ভালো করলেও, নির্দিষ্ট মাত্রার উপরে ওষুধ বিষ। আবার কোনো ওষুধ একটি রোগ ভালো করতে গিয়ে আরেক দিকে সমস্যা বাধায়। যেমন, সর্দি হলে আমরা অ্যান্টি-হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খাই। সর্দি কমানোর পাশাপাশি সেগুলো আমাদের ঘুমের রাজ্যে নিয়ে যায়।
ডাক্তারি পড়তে গিয়ে ওষুধ সম্পর্কে জানতে হয়। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফার্মেসি নামে একটি বিষয় আছে। সেখানে কেবল ওষুধ সম্পর্কেই পড়ানো হয়। প্রশ্ন হলো বিষয়টি কাঠখোট্টা না মজার?
এতক্ষণ ধরে চলে আসতে থাকা আলোচনায় মনে হতেই পারে বিষয়টি কাঠখোট্টা। তবে জীবনের সাথে আর জীবন বাঁচানোর সাথে জড়িত বলে, বিষয়টির দায় অনেক। কারণ, মাত্র একজন ওষুধবিজ্ঞানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার একসাথে কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে। আবার ওষুধ কোম্পানির একজন ফার্মাসিস্টের একটি সিদ্ধান্ত কেড়ে নিতে পারে অনেক জীবন। তাই বলাই যায়, বিষয়টির মাঝে অ্যাডভেঞ্চার আছে!
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, জুন ১১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি, মেইল[email protected]