ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও দেবী দুর্গা

ইমরুল ইউসুফ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৩
সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও দেবী দুর্গা

  যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে
যা হচ্ছে, তা ভালোই হচ্ছে।
যা হবে, তা ভালোই হবে।


তোমার কি হারিয়েছে, যে তুমি কাঁদছো?
তুমি কি নিয়ে এসেছিলে, যা তুমি হারিয়েছ?
তুমি কি সৃষ্টি করেছ যা নষ্ট হয়ে গেছে?
তুমি যা নিয়েছ, এখান থেকেই নিয়েছ।
যা দিয়েছ, এখানেই দিয়েছ।
তোমার আজ যা আছে,
কাল তা অন্য কারো ছিল।
পরশু সেটা অন্য কারো হয়ে যাবে।
পরিবর্তন সংসারের নিয়ম।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ শ্রী শ্রী গীতার সারাংশে উপরের কথাগুলো বলা হয়েছে। আসলেই পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তনের পিছনে কাজ করে দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান কোনো শক্তি। অদৃশ্যমান সেইসব শক্তির মিলিতরূপ দেবী দুর্গা। এজন্য তাঁকে সবাই খুব ভক্তিভরে স্মরণ করে। তাঁকে ঘিরে উৎসব করে। তাই হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম দুর্গা পূজা।

দুর্গার গায়ের রং অতসী ফুলের মতো সোনালি হলুদ। পূর্ণিমার চাঁদের মতো সুন্দর তাঁর তিনটি চোখ। এ জন্য তাঁকে বলা হয় ত্রিনয়নী। এই ত্রিনয়ন বা তিনটি চোখের একটি চোখ চন্দ্রস্বরূপ, আরেকটি সুর্যস্বরূপ এবং অপরটি অগ্নিস্বরূপ। এই তিনটি চোখের মধ্যে একটি চোখ থাকে তাঁর কপালের মাঝখানে। মাথার এক পাশে থাকে বাঁকা চাঁদ। বাহন তার সিংহ।

পুরাণে বলা হয়েছে ব্রহ্মের বরে পুরুষের অবধ্য মহিষাসুর নামে এক দানব স্বর্গরাজ্য দখল করলে রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনি দুর্গা। দেবী দুর্গা আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শিবানী, ভবানী, দশভুজা, সিংহবাহনা প্রভৃতি নামে অভিহিত। দুর্গা নামটির নানা ব্যাখ্যা আছে। দুর্গতি বা কষ্ট থেকে রক্ষা করেন বলে তিনি দুর্গা।

দুর্গ নামের এক অসুরকে বধ করেছিলেন বলে তাকে বলা হয় দুর্গা। পুরাণ মতে দুর্গা মহাদেব বা শিবের স্ত্রী। দুর্গার বহু রূপের কথা পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। দৈত্য মহিষাসুর একবার দেবতাদের রাজা ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতাদের স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত করে সেখানকার রাজা হয়ে বসে। দুর্গা সেই মহিষাসুরকে বধ করেন। তখন তাঁর নাম হয় মহিষমর্দিনী। দেবী পুরাণ, দেবী ভাগবত, বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে দুর্গা ও তাঁর পূজার উল্লেখ আছে।

দুর্গাপূজার প্রচলন সম্পর্কে ইতিহাসে বলা হয়েছে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তে তিনি এই পূজার আয়োজন করায় দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী পূজাও বলা হয়। কিন্তু রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে যাওয়ার আগে রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন শরৎকালের অমাবস্যা তিথিতে। এজন্য শরৎকালের এই পূজাকে হিন্দুমতে অকালবোধনও বলা হয়। জীবনে অশুভ অসুর শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ সুর শক্তির  প্রতিষ্ঠা করাই দূর্গা পূজার মূল দর্শন। প্রতীকী সাকার (মুর্তিপূজার) মাধ্যমে নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করা হয় দুর্গা পূজার মাধ্যমে। পুরান অনুযায়ী ‘দুর্গা’ শব্দটির ‘দ’ বর্ণটি দৈত্যনাশক (বিপদ), ‘উ’ (রসু) বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগ নাশক, ‘গ’ পাপনাশক এবং ‘আ’ ভয় ও শত্রু নাশক। এ পূজার মাধ্যমে ভক্তরা জীবনের সমস্ত ক্ষয় কাটিয়ে মুক্তির প্রার্থনা করেন।

দুর্গার দশটি হাত। এজন্য তাঁর আরেক নাম দশভুজা। দশ হাতে তার দশটি অস্ত্র থাকে। এই অস্ত্র দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। শত্রুদের ধ্বংস করেন। দমন করেন খারাপ মানুষকে। আর রক্ষা করেন ধার্মিক, সৎ ও ভালো মানুষদের। দেবী দুর্গাকে বলা হয় সর্বমঙ্গলা। তিনি সবসময় সবার মঙ্গল কামনা করেন। হিন্দু ধর্ম মতে, যে যা প্রার্থনা করে তিনি তাকে তাই দিয়ে থাকেন। দুর্গা নাম স্মরণ করলে সব বিপদ দূর হয়। সেজন্য ভক্তরা কোথাও যাওয়ার আগে দুর্গা, দুর্গা বলে থাকেন। শরৎকালের এ মহাপূজায় বাঙালির হৃদয়ে দেবীর অধিষ্ঠান হয় কন্যারূপে। বাঙালি হিন্দুরা মনে করেন যে শারদ উৎসবের মধ্য দিয়ে কন্যাস্থানীয় দেবী যেন সপরিবারে বাবার বাড়িতে আসেন। এর মধ্যে মাতৃরূপে দূর্গাপূজার মাধ্যমে ভক্তরা মাতৃভূমি ও মানবের মঙ্গল কামনা করেন।

শাস্ত্রীয় বিধানে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে এবং চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দুর্গোৎসব পালন করা যায়। চৈত্র অর্থাৎ বসন্তকালের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা ও আশ্বিন অর্থাৎ শরৎকালের এই পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। বাংলায় শারদীয় দুর্গাপূজা বেশি জনপ্রিয়। প্রতিবছর সাধারণত আশ্বিন মাসে এই পূজা হয়। এবছরও আশ্বিন মাসে দুর্গা পূজা এসেছে। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান এই উৎসব ভারতের যারা বাঙালি না তারাও পালন করে থাকে। তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। যেমন কাশ্মীরে অম্বা, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রাণী, মিথিলায় উমা এবং কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী।

এই পূজা তিন প্রকার। সাত্ত্বিক (জপ, যজ্ঞ ও নিরামিষ ভোগ দ্বারা পূজা), তামসিক (কিরাতদের জন্য বিহিত; এতে জপ, যজ্ঞ ও মন্ত্র নেই; মদ্য, মাংস প্রভৃতি দ্বারা পূজা করা হয়) ও রাজসিক (পশুবলি ও আমিষ ভোগ করে পূজা করা হয়)। সারাদেশে ধুমধাম করে পালিত হয় শারদীয় দুর্গা পূজা। অনেক আশা আর আনন্দ নিয়ে ভক্তরা দুর্গা পূজা পালন করে। কেউ ব্যক্তিগতভাবে এই পূজা করে। আবার কেউবা করে সমষ্টিগতভাবে। সমষ্টিগতভাবে করা পূজাকে বলা হয় বারোয়ারি বা সার্বজনীন দুর্গোৎসব।

এসময় শুক্লা ষষ্ঠীতে হয় দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস। এবং সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী (মহানবমী)-তে পূজা দিয়ে দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। পূূজার এই সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে পরিচিত। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন। এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত।

অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়। এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসেবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। পশ্চিমবঙ্গের কোনোও কোনোও পরিবারে অবশ্য পনেরো দিন দুর্গোৎসব পালনের প্রথা আছে। আমাদের দেশে কেবলমাত্র বিজয়া দশমীর দিন সরকারি ছুটি থাকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় মহাসপ্তমী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত চারদিন থাকে সরকারি ছুটি।

পূজা উপলক্ষে দেশের প্রায় সব জায়গায় মেলা বসে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সংগীতানুষ্ঠান, নৌকাবাইচ হয়। নতুন পোশাক পরে সকাল থেকেই চলে প্রণাম, আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা বিনিময়। মহাসপ্তমীর দিন হয় নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমীবিহিত পূজা প্রভৃতি। অষ্টমীর দিন হয় মহাষ্টমীবিহিত পূজা, বীরাষ্টমী ব্রত, মহাষ্টমী ব্রতোপবাস, কুমারী পূজা, অর্ধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা, মহোৎসবযাত্রা, সন্ধিপূজা ও বলিদান। মহানবমীর দিন হয় মহানবমীকল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত পূজা প্রভৃতি। বিজয়া দশমীর দিন সাধারণত হয় বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, বিজয়া দশমী কৃত্য ও কুলাচার অনুসারে বিসর্জন শেষে অপরাজিতা পূজা। ওই দিন মাটির প্রতিমা খাল, বিল, নদীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় পূজার পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব।

হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এই পূজার মধ্য দিয়ে ভক্তদের সব আশা পূর্ণ হয়। পাপ মোচন হয়। আমরাও চাই তাদের সব আশা পূর্ণ হোক, তাদের জীবন থেকে দূর হোক মন্দ আর সব অশুভ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০১৩
এএ/জিসিপি- [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।