এতোক্ষণ শার্ট ধরে রাখলেও এবার হাতটা সরিয়ে নিয়েছে ছেলেটা। গায়ের লাল গেঞ্জিটা ময়লায় কালচে হয়ে গেছে।
সৌরভ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না। এ ধরনের ছেলেদের যে সে আগে কখনো দেখেনি তা নয়। ভার্সিটি ক্যাম্পাসে, হলের সামনে বা রাস্তাঘাটে প্রায়ই এদের দেখা যায়। কখনো ছেলেদের শার্ট বা মেয়েদের জামা ধরে টানে, কখনো হাতে পায়ে জড়িয়ে ধরে বলে, 'টাকা দেন'। কিন্তু তাদেরই কেউ শার্ট টেনে বই চাইছে এমন অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম।
তুই করে বলতে নিয়েও থেমে গেলো সৌরভ। এতোদিন কাউকে টাকা না দিয়ে যা ভাগ বলে তাড়িয়ে দিতো। রেল স্টেশনে, বস্তির ধারে এ বয়সী অনেককে নেশা করতে দেখার পর থেকেই এদের থেকে কয়েক হাত দূরে থাকে সে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, 'তুমি পড়তে পারো?'
'একটু একটু পারি। '
'স্কুলে পড়ো?'
'না। তয় অ, আ, ক, খ চিনি। '
সৌরভ বললো, 'কি বই কিনবে?'
'গল্পের বই। ফুল ছবি আঁকা গল্পের বই কিনমু। '
'দেখো, কোন বই কিনবে। কিনে দেবো আমি। '
স্টলের সামনে সাজানো বইগুলো এবার উল্টে পাল্টে দেখা শুরু করলো ছেলেটা। এ স্টলে পছন্দ হচ্ছে না দেখে পাশের স্টলে নিয়ে গেলো সৌরভ। কয়েকটা বই নেড়ে শেষ পর্যন্ত একটা বই পছন্দ হয়ে গেলো।
'ভাইয়া, এইটা নিমু। '
সৌরভ পৃষ্ঠা উল্টে দেখলো এটা রাজপুত্র, রাজকন্যার গল্পের বই। বেশিরভাগ অংশই ছবি। সাথে ছোট ছোট আকারে তাদের গল্প। বইটা কিনে তার হাতে দিতেই হইইইই করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চিৎকার করতে নিলো ছেলেটা। সৌরভ তাকে থামিয়ে বললো, 'আস্তে! এখানে এতো জোরে চিৎকার করে না। লোকে খারাপ ভাববে। চলো বাইরে গিয়ে গল্প করি। '
মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে এসেছে দু’জনে। সৌরভ দেখলো ছেলেটার চোখেমুখে সে কি আনন্দ। প্যাকেটের মধ্যে বইটা রাখা তার সহ্য হচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে প্যাকেট থেকে বইটা বের করে নিয়েছে সে।
আশেপাশে কয়েকটা আইসক্রিম ভ্যান দেখে সৌরভ বললো, 'আইসক্রিম খাবে?'
'হ, খামু। '
দুইটা কাপ আইসক্রিম নিয়ে ফুটপাতে বসলো দুজনে। এতোক্ষণেও ছেলেটির নাম জানা হয়নি। 'নাম কি তোমার?' প্রশ্ন করতেই বললো
'শুভ'
'পুরো নাম কি?'
'পুরা নাম জানি না। তয় আব্বার নামে মিয়া আছে তো, শুভ মিয়া হইতে পারে। '
'দারুণ নাম তোমার। পড়াশোনা করো না?'
'নাহ। মা'য়ে মাঝেমইধ্যে একটু একটু পড়ায়। আর কয়দিন ফুটপাতে কয়েকটা ভাইয়া পড়াইতো। ঐখানে যাইতাম। '
'তোমার মা পড়াশোনা পারে?'
'হ, প্রাইমারি স্কুলে পড়ছিলো। এহন বাসাবাড়িতে কাজ করে। কিন্তু আব্বা পড়তে পারে না। রাস্তা ঝাড়ু দেয়। '
'স্কুলে যাও না কেনো?'
'আব্বা কইছে, পড়তে বহুত খরচ। ব্যাগ লাগে, কলম-পেন্সিল লাগে, মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ন লাগে। আর একটু বড় হইলে গ্যারেজে দিয়া দিবো। নইলে লেগুনার হেলপারি করমু। '
এর মধ্যেই শুভকে দেখে তার কয়েকজন সঙ্গী এসে জুটে গেলো। একজন জানতে চাইলো, 'বই পাইলি কই?'
হাসিমুখ করে শুভ বললো, 'ভাইয়া কিন্না দিছে'
'আমাদেরও কিন্না দেন বই'
'তোমরা পড়তে পারো?' জানতে চাইলো সৌরভ।
একজন বললো, 'পড়াইলে পারি'
আরেকজন বলে উঠলো, 'আমি বানান করতে পারি'
সৌরভ বললো, 'বই কিনতে ইচ্ছে হয় তোমাদের?'
'ইচ্ছা হয়, কিন্তু কে কিন্না দিবো? আমগো তো খাওনেরই পয়সা নাই'
আমি কিনে দেবো বলতেই কয়েকজন হই হই করে দেয়াল বেয়ে মেলায় ঢুকতে নিলো। সৌরভ ডেকে বললো, 'এদিকে নয়, গেট দিয়ে চলো। '
'আমগো তো গেটে ঢুকতে দেয় না। আটকায় দেয় স্যারেরা। আমিও তো ওয়াল দিয়া ঢুকছিলাম। ' শুভ ফোড়ন কাটলো।
'আমার সাথে যাবে। এসো..' বলে সবাইকে নিয়ে মেলায় ঢুকলো সৌরভ। শিশু চত্বরে সবাইকে পছন্দের বই কিনে দিলো সৌরভ। বাচ্চারা বই হাতে পেয়ে পাতা উল্টে দেখছে। একে অন্যকে নিজের বই দেখিয়ে গল্প জুড়ে দিচ্ছে। চোখে মুখে তাদের আনন্দের ছাপ!
খুশিতে সৌরভের চোখও ঝাপসা হয়ে এলো। সে ভাবছে, একটা বইমেলা হবে। পথশিশুদের বইমেলা। শিশুরা আসবে, বইয়ের পাতা উল্টে দেখবে। শার্ট টেনে ধরবে। এবার আর টাকা চাইবে না তারা, বই চাইবে। যে পারবে, নামমাত্র মূল্যে বই কিনবে। যারা পারবে না, তারা এমনিতেই বই পাবে। তবুও তারা বই পড়বে। গল্পের বই, কবিতার বই। বইয়ের সৌরভে ভরে উঠবে তাদের জীবন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
এএ