ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

সবচেয়ে বড় শাস্তি পেয়ে গেছি আমি: ওসি মোয়াজ্জেম

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৯
সবচেয়ে বড় শাস্তি পেয়ে গেছি আমি: ওসি মোয়াজ্জেম

ঢাকা: ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে বক্তব্য দিয়েছেন ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন। ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আদালতে অঝোরে কেঁদে বলেন, এ অভিযোগে যত বড় শাস্তিই দেন না কেন, তার চেয়ে বড় শাস্তি আমি পেয়ে গেছি।

বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালতে এ বক্তব্য দেন তিনি।

মোয়াজ্জেম হোসেন, ‘সামাজিকভাবে এ মামলার কারণে হেয় হয়েছি অনেক।

আমার ১৫ বছরের ছেলে স্কুলে যেতে পারে না। আমি ১০টা খুন করলেও এতো বড় সাজা হতো না। ৭০/৭৫ বয়সী আমার মা এ ঘটনায় খুবই মর্মাহত হয়েছেন। আমি কী অপরাধ করলাম! উনি (বাদী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন) যদি ভিডিওটা পুরোপুরি দেখতেন, তবে এ মামলা করতেন না। উনি ভিডিও ঠিকমতো দেখেনই নাই।

তিনি বলেন, গত ৬ থেকে ৭ মাস আমাকে সারাবিশ্বে কলঙ্কিত করা হয়েছে। চাকরি থেকে আমাকে রংপুরে ক্লোজ করা হয়। আমার বিরুদ্ধে জুতা মিছিল পর্যন্ত হয়েছে। অথচ আমি এ মামলায় আইওকে (তদন্তকারী কর্মকর্তা) সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়েছি। আমার মোবাইল তার কাছে জমা দিয়েছি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এমন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে মামলা পড়েছে যিনি আইনানুযায়ী তদন্ত করেননি। উনি (আইও) নিজেই তদন্তের প্রয়োজনে ছবি তুলেছেন।

তখন বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, আপনার জবানবন্দি গ্রহণকালে আইও কোনো ভিডিও নিয়েছেন কি-না? জবাবে ওসি মোয়াজ্জেম বলেন, না।

ওসি মোয়াজ্জেম বলেন, আমার থানায় সিসি ক্যামেরা আছে। আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে যে স্ক্রিন শট দিয়েছি, সেখানে তারিখ দেখে তিনি ঘটনার সময় উল্লেখ করেছেন। এডিশনাল ডিআইজি ফায়েজ স্যার আমার কাছ থেকে ভিডিও নিয়েছেন। সেটা আমি তাকে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছি। আমি নিজে ফেসবুক ব্যবহার করি না। শুধু ঘটনার পরদিন রাতে এসপি সাহেব ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। দু’দিন পরই আমি তা আবার ডিয়েক্টিভ করে দেই।

তখন বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, মামলা দায়ের বা তদন্তের জন্য ভিডিও রেকর্ডের কোনো নির্দেশ করে কোনো আইন আছে কি-না? জবাবে মোয়াজ্জেম বলেন, না সেরকম কোনো আইন নেই। তবে টেকনোলজির আপডেটের কারণে আমরা অনেক কিছু ভিডিও ধারণ করে রাখি। এটা আমাদের প্র্যাকটিস আছে এক্ষেত্রে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের কিছু নির্দেশনাও আছে।

তখন বিচারক বলেন, বাদী, সাক্ষী তো দূরে থাক গ্রেফতারের পর আসামির ভিডিও বা ছবি না তোলার ব্যাপারে তো হাইকোর্টের নির্দেশনাই আছে।

তখন মোয়াজ্জেম বলেন, জ্বি তা আছে। এগুলো ভিডিও করে আমরা কাউকে দেই না। শুধুমাত্র আদালত চাইলে সাক্ষ্য হিসেবে তা উপস্থাপন করা হয়। আমরা এটা ফেসবুক বা ইউটিউবে পোস্ট করি নাই। কিভাবে গিয়েছে তা স্যোসাল মিডিয়ায় গিয়েছে তা আমি জানি না।

জ্ঞানত আমি কোনো অপরাধ করি নাই। আমি মুসলমান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আমি স্যারের কাছে ন্যায়বিচার চাই।  

এসব বক্তব্যের সবিস্তার তিনি লিখিত আকারে আদালতে জমা দেন। তবে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনো সাফাই সাক্ষী দেবেন না বলে জানান তার আইনজীবী ফারুক আহাম্মাদ। এরপর আদালত আগামী ২০ নভেম্বর এ মামলার যুক্তিতর্কের জন্য দিন ধার্য করেন।

এ মামলায় বাদী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন, নুসরাতের মা, ভাই ও দুই বান্ধবী, দুই পুলিশ সদস্য ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১২ জন রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। গত ১২ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তার জেরে শেষের মাধ্যমে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওইদিনই আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বৃহস্পতিবার দিন রেখেছিলেন। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার আসামি ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে তার বক্তব্য তুলে ধরেন।

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ‘অসম্মানজনক’ কথা বলায় ও তার জবানবন্দি ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গত ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। ওইদিনই আদালত এ মামলার তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।

গত ২৭ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানার পক্ষে মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় পিবিআই। একইদিনে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

গত ১৬ জুন রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। পরে ১৭ জুলাই আদালত আসামি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

এ বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজ-উদ দৌলাকে পরে গ্রেফতার করা হয়। তবে অভিযোগ দেওয়ার সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্নের পাশাপাশি তার বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি মোয়াজ্জেম। পরে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় ভিডিওতে দু’জন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তার আইনজীবী ছিলেন না।

গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আগমুহূর্তে বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে সেই মামলা তুলে নিতে চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে অস্বীকৃতি জানালে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা।

ওইদিন নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গত ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়।

হত্যা মামলায় এরই মধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ফেনীর একটি আদালত।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৯
কেআই/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।