ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

ব্যবসায়িক সঙ্গীকে হত্যার ঘটনায় ২ জনের মৃত্যুদণ্ড

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৬ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০২২
ব্যবসায়িক সঙ্গীকে হত্যার ঘটনায় ২ জনের মৃত্যুদণ্ড

লক্ষ্মীপুর: ক্রিকেট (আইপিএল) জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে ব্যবসায়িক সঙ্গী আলমগীর হোসেনকে হত্যার দায়ে মেহেদী হাসান রুবেল ওরফে হাসিম (৩৪) ও ফয়েজ আহাম্মদ (২৭) নামে দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

একই মামলায় ঘটনার সময় ব্যবহৃত অটোরিকশার চালক সাগরকে (২৩) বেকসুর খালাস দেন আদালত।

 

মঙ্গলবার (৫ জুলাই) দুপুর ১২টার দিকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রহিবুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন।  

এ সময় আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেহেদী হাসান রুবেল ও খালাসপ্রাপ্ত সাগর উপস্থিত ছিলেন। মেহেদী ঘটনার পর থেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দি ছিলেন।

দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি ফয়েজ ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন। খালাসপ্রাপ্ত অটোরিকশাচালক সাগর আদালত কর্তৃক জামিনে মুক্ত ছিলেন।  

মেহেদী হাসান রুবেল সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম বটতলী গ্রামের মিয়াজান বেপারী বাড়ির সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে। ফয়েজ আহম্মদ একই এলাকার কাঁঠালী বাড়ির আবদুল্লার ছেলে। অটোরিকশাচালক সাগর মান্দারী ইউনিয়নের দক্ষিণ মান্দারী গ্রামের কওলা মুন্সি বাড়ির জামাল উদ্দিনের ছেলে। আর ভুক্তভোগী আলমগীর রায়পুর উপজেলার বামনী ইউনিয়নের সাইচা গ্রামের মৃত বশির উল্যার ছেলে।

জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।  

আদলত সূত্র জানায়, গত ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট রাতে আসামি মেহেদী হাসান তার ব্যবসায়িক সঙ্গী আলমগীরের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নিতে ফয়েজ আহম্মদের সহায়তায় তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। ঘটনার পর আলমগীরের ভাই হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে সদর থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলা তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আলম।  

মামলার তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মো. আলমগীর হোসেন এবং মেহেদী হাসান রুবেল ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। তারা ইট, বালু, সয়াবিন ও সুপারীসহ বিভিন্ন মালামালের ব্যবসা করতেন।  

দুইজনের মধ্যে সুপারীর ব্যবসাকেন্দ্রীক টাকা লেনদেন ছিল। মেহেদী হাসান আইপিএল জুয়া খেলে ৮ লাখ টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। একপর্যায়ে দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন তিনি। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে সেগুলো পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছিলেন মেহেদী। ব্যবসায়িক অংশীদার মো. আলমগীর হোসেনও তার কাছ থেকে ১৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। টাকার জন্য অন্য পাওনাদারের পাশাপাশি চাপ দিচ্ছিলেন তিনিও। তাই তাকে ৩ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মেহেদী হাসান। তবে সঙ্গে পরিকল্পনা করেন টাকা দেওয়ার পর অন্য আরেকজনকে দিয়ে সেগুলো ছিনতাই করিয়ে আরেক দেনাদারকে দেবেন।  

এ জন্য মেহেদী তার চাচাতো ভাই ফয়েজের সঙ্গে চুক্তি করেন। ফয়েজ পেশাদার ডাকাত ও ভাড়াটে খুনি। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করলে তিনি পাওনাদার আলমগীর হোসেনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে মতে তারা পুরো পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করেন। আর হত্যার জন্য ৫০ হাজার টাকা চুক্তিবদ্ধ হয়। মেহেদী মোবাইল ফোনে আলমগীরকে ছয় লাখ টাকা নিতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী বাজারে আসতে বলেন। আলমগীর ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট দুপুরে টাকার জন্য মান্দারী বাজারে এলে একটি দোকানে বসিয়ে তার হাতে তিন লাখ টাকা দেন। এ সময় ফয়েজও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা তিনজন তিনটি কোমল পানীয় পান করেন, তবে আলমগীরকে দেওয়া কোমল পানীয়তে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া হয়।

মেহেদী বাকি তিন লাখ টাকা সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জের মিয়ারবেড়ী থেকে নিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আলমগীরকে পরিচিত একটি অটোরিকশায় করে সেদিকে নিয়ে যান।  বিভিন্ন টালবাহানা করেন এবং তাকে মতিরহাট থেকে ইলিশ মাছ কিনে দেওয়ার কথা বলে সেখানে নিয়ে যান। সেখান থেকে মাছ না কিনেই তারা রাত প্রায় ৮টার দিকে লক্ষ্মীপুর উত্তর স্টেশনে চলে আসেন। কোমল পানীয়ের সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করায় আলমগীরের মধ্যে ঝিমুনির ভাব হচ্ছিল। তিনি স্টেশন থেকে মেহেদী এবং ফয়েজের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলে তারা তাকে একা না ছেড়ে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া কথা বলে তাকে নিয়ে রায়পুরের উদ্দেশে রওনা দেন। তাদের অটোরিকশাটি রায়পুর বাসাবাড়ির মিল গেট এলাকায় পৌঁছালে চলন্ত অটোরিকশার মধ্যে মেহেদী দুই হাত চেপে ধরেন আলমগীরের। এ সময় ফয়েজের সঙ্গে থাকা একটি ছুরি দিয়ে আলমগীরের গলায় পোচ দেন এবং পেটে একাধিক আঘাত করেন। এ ঘটনায় অটোরিকশাচালক সাগর আপত্তি জানালে তাকেও হত্যার হুমকি দেন এবং তাদের কথামতো অটোরিকশা চালানোর নির্দেশনা দেন। অটোরিকশার মধ্যেই আলমগীরের মৃত্যু নিশ্চিত করে দালালবাজার-মীরগঞ্জ সড়কের কাজির দিঘির পাড় সংলগ্ন একটি পুকুরে মরদেহটি ফেলে দেন।  

এ সময় আলমগীরকে দেওয়া তিন লাখ টাকা ও তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে নেন মেহেদী। এরপর তারা ওই অটোরিকশায় বাড়ি চলে আসেন এবং ফয়েজকে চুক্তিভিত্তিক ৫০ হাজার টাকা দেন।  আর চালক সাগরকে পুনরায় হত্যার হুমকি দিয়ে চুপ থাকতে বলেন। এরপর মেহেদী তার রক্তমাখা জামা-কাপড় ধুয়ে ওই রাতেই আড়াই লাখ টাকা অন্য পাওনাদারকে বুঝিয়ে দিয়ে আসেন।  

এদিকে রাতে ভিকটিম আলমগীরের খোঁজ না পেয়ে পরদিন ভোরে তার পরিবারের সদস্যরা বাড়ির অদূরে ক্ষতবিক্ষত একটি মরদেহের সন্ধান পান। সেটি আলমগীরের বলে শনাক্ত করেন তারা। পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালে পাঠায়।  

এদিন (২০২০ সালের ২১ এপ্রিল) আলমগীরের ভাই হুমায়ুন কবির সদর থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ এ ঘটনায় তদন্ত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ভিকটিম আলমগীরের ব্যবসায়িক সঙ্গী মেহেদী ও চালক সাগরকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসবাদ করলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তারা।  পরে মামলাটি জেলা গোয়েন্দা শাখার পুলিশ পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আলম তদন্ত করেন। আদালতে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মেহেদী হাসান রুবেল, চালক সাগর ও ভাড়াটে খুনি ফয়েজের নামে ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল অভিযোগপত্র দাখিল করেন।  

আদালত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মেহেদী ও ফয়েজকে ফাঁসির রায় দেন। আদালতের রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট হয়েছে বলে জানান পিপি জসিম উদ্দিন।  

মামলার বাদী হুমায়ুন কবির রায়ে সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বলেন, আসামিরা যাতে আপিল করে বের হয়ে যেতে না পারে, আমি সরকারের কাছে সে অনুরোধ জানাই। আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসির আদেশ দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।